যে প্রকাশ্যে ইসলাম চর্চা করে; কিন্তু গোপনে অন্তরে কুফরী বা ইসলামের প্রতি অবিশ্বাস লালন করে
ইসলামি পরিভাষায় মুনাফিক ওই সব লোককে বলা হয়, যারা মুখে মুখে আল্লাহর প্রতি ইমান আনে, কিন্তু অন্তরে ঘোর অবিশ্বাস পোষণ করে। হজরত রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের পর এক ধরনের কপট গোষ্ঠীর মুখোমুখি হন। তাদের নেতা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এবং ইবনে সুলুল। তারা উভয়কূল রক্ষার জন্য ভেতরে এবং বাইরে ভিন্ন ভিন্ন নীতি গ্রহণ করে। কোরআনে করিমে তাদের অবস্থা এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন তারা মুমিনদের সংস্পর্শে আসে, তখন বলে, আমরা ইমান এনেছি এবং যখন তারা নিভৃতে তাদের শয়তানদের (দোসর, সঙ্গী-সাথী) সঙ্গে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা তো তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি; আমরা শুধু তাদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি।’ সুরা আল বাকারা : ১৪
মুনাফিক (আরবিতে: منافق, বহুবচন মুনাফিকুন) একটি ইসলামি পরিভাষা যার অর্থ একজন প্রতারক বা “ভন্ড ধার্মিক” ব্যক্তি। যে প্রকাশ্যে ইসলাম চর্চা করে; কিন্তু গোপনে অন্তরে কুফরী বা ইসলামের প্রতি অবিশ্বাস লালন করে। আর এ ধরনের প্রতারণাকে বলা হয় নিফাক (আরবি: نفاق)।(উইকিপিডিয়া)
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি সমাজেই এ ধরনের দ্বৈত চরিত্রের কপট ও সুবিধাবাদী লোকদের উপস্থিতি ছিল। বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাসে এই চরিত্রের লোকদের আলোচনা নানাভাবে, নানা প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে গুরুত্ব সহকারে। কারণ মুনাফিকরা মদিনার রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা ছিল বেশি বিপজ্জনক। এ সময়টায় কাফেররা যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মুনাফিকরা। কারণ দৃশ্যত তাদের অবিশ্বাস করা যাচ্ছিল না, আবার তাদের বিশ্বাসও করা যাচ্ছিল না। বিষয়টি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবিদের জন্য উভয়সংকট সৃষ্টি করে। তাদের সম্পর্কে কোরআনে করিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুনাফিক নর-নারীর গতিবিধি এ রকম, অসৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং সৎকাজে বাধা দেয় এবং কল্যাণকর কাজ থেকে নিজেদের হাত ফিরিয়ে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, কাজেই আল্লাহও তাদের ভুলে গেছেন। নিঃসন্দেহে মুনাফিকরাই নাফরমান।’ সুরা তাওবা : ৬৭
বস্তুত মুনাফিকি স্বভাব হচ্ছে একটি মানসিক অবস্থা। সব দেশে, সব কালে এর লক্ষণসমূহ প্রমাণিত। এর অনুষঙ্গ হিসেবে যেসব দোষাবলির কথা কোরআনে করিমে বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ধোঁকাবাজি, ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর, মিথ্যাচার, ফ্যাসাদকারী এবং সংশোধনকারী। এখানে সংশোধনকারী শব্দটি স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী অর্থে গৃহীত। তারা ইমানদার তথা সাধারণ মুসলমানদের নির্বোধ মনে করে।
নবী মুহাম্মদ(সঃ) বলেছেন :
“চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হবে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়। সেগুলো হলো: ১. সম্পদ গচ্ছিত রাখা হলে তা হনন করে; ২. কথা বললে মিথ্যা বলে; ৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে; এবং ৪. বিবাদে লিপ্ত হলে বিস্ফোরিত হয় (فَجَرَ, ফাজারা)/অশ্লীল গালি দেয়/সত্য থেকে বিচ্যুত হয়/অত্যন্ত অবিবেচক, অযৌক্তিক, মূর্খ, মন্দ এবং অপমানজনকভাবে আচরণ করে।”[৪] (উইকিপিডিয়া)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং তার কাছে কেউ আমানত রাখলে তা খেয়ানত করে।’ সহিহ্ বোখারি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আরও দুটি বৈশিষ্ট্য সংযোজন করেছেন, তা হলো ‘ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে এবং চুক্তি করলে বিশ্বাসঘাতকতা করে।’ জামে তিরমিজি
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেক হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এমন দুটি গুণ আছে যা মুনাফিকের মধ্যে একত্রিত হতে পারে না। প্রথমটি, নেক চরিত্র এবং দ্বিতীয়টি দীনের যথার্থ জ্ঞান।’ তিরমিজি
কোরআন মজিদে মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ সতর্ক করেছেন এই বলে, ‘এই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেছে, অথচ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাদের ধোঁকার প্রতিফল প্রদান করবেন। তারা যখন নামাজের জন্য দাঁড়ায়, তখন অনিচ্ছা ও শৈথিল্যসহ শুধু লোকদেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তারা কমই স্মরণ করেন। তারা কুফরি ও ইমানের মাঝখানে দোদুল্যমান; না পূর্ণভাবে এদিকে, না পূর্র্ণভাবে ওদিকে। বস্তুত আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার মুক্তির জন্য আপনি কোনো পথ পাবেন না।’ সুরা নিসা : ১৪২-১৪৪
ইসলামের ইতিহাসের নানা মুহূর্ত ও বাঁক মুনাফিকদের দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রতারিত ও প্রভাবিত হয়েছে। কোরআন মজিদে ‘মুনাফিকুন’ নামে স্বতন্ত্র একটি সুরা রয়েছে। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, মুনাফিকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকদের চেনার বহু আলামত রয়েছে। তাদের সালাম হলো অভিশপ্ত, তাদের রুজি লুটপাট, তাদের গণিমত হারাম ও খেয়ানত, তাদের অপছন্দনীয় কাজ মসজিদের নৈকট্য, তাদের নামাজ হলো শেষ ওয়াক্তে, তারা অহংকারী ও দাম্ভিক, নম্রতা, বিনয় ও আত্মনিবেদন তাদের ধাতে সয় না, তাদের নিজেদের মধ্যে তা নেই এবং অপরের করাকেও পছন্দ করে না, তারা দিনের বেলায় খুব আনন্দ-ফুর্তি করে এবং রাতে মরা কাঠের মতো পড়ে পড়ে ঘুমায়।’ তাফসিরে ইবনে কাসির
মানুষ মজ্জাগতভাবে যেসব দোষ ধারণ করে, মুনাফিকরাও তাই ধারণ করে। বর্ণিত কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি থেকে তা প্রমাণিত। দুনিয়ায় মুনাফিকরা ষড়রিপুর তাড়না দ্বারা ভয়ংকরভাবে তাড়িত। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এসব হচ্ছে ষড়রিপু। মুনাফিকরা ষড়রিপু নিয়ে জীবন ধারণ করে। ব্যক্তি জীবনে যেমন এসব ধারণ করে, তেমনি সমাজ, সরকার এবং রাষ্ট্রে যখন তারা ক্ষমতা প্রয়োগ করে, ওই সব গুণাবলি প্লাবন ঘটে তখন। কাম-প্রবৃত্তি ব্যক্তি জীবনেই প্রকাশ ঘটে না, সামাজিকভাবে তা তখন মহামারী আকারে দেখা দেয়। তাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো মাত্রা থাকে না। স্বার্থপরতা তাদের এমনভাবে ঘিরে ধরে, অন্যের কথা ভাবার অবকাশ থাকে না। মনের দিক থেকে তারা এতটাই গরিব যে, অন্যকে বড় চোখে দেখতে পারে না। তারা হয়, পাশবিক, বর্বর, পশুবৎ, নিষ্ঠুর, নির্দয়, অশিষ্ট, পশু প্রকৃতির ও নির্বোধ।
দেড় হাজার বছর আগে মুনাফিকদের সম্পর্কে ওইসব কঠিন ও কঠোর মন্তব্য ইসলামের ইতিহাসে একটি কলংকিত অধ্যায়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, ওই সময়কাল থেকে আজ অবধি মুনাফিকের অবসান হয়নি। দেশে দেশে, সময়ে-অসময়ে প্রতিটি অধ্যায়ে মুনাফিকদের অবস্থান লক্ষ করা গেছে। সেই কুফা কিংবা কারবালা থেকে আজও অবসান হয়নি মুনাফিকির। সেই অতীতের মতো বরাবরই মুনাফিকরা মুসলিম উম্মাহর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা, নির্দয়তা ও গুম-খুন সমাজকে বিপর্যস্ত করেছে।
এখানে একটি ট্র্যাজেডি হলো, সেকালের মুনাফিকরা চিহ্নিত ছিল, এখন মুনাফিকদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। মুসলমানরাই ইমানদার, আবার তারাই মুনাফিক। সত্যি কথা বলতে কী, দেড় হাজার বছর আগের সেই বাস্তবতা আজও বর্তমান। বর্তমানে কঠিন এ জন্য, আপনার বাড়ির কাছের আরশি নগরে আরশিকে কী করে আপনি চিনতে পারবেন? সে আপনার মতো একই চেহারার মানুষ, আপনার মতোই লেবাসধারী, আপনার মতোই ডাল-ভাত খায় এবং একই সমতলে বসবাস করে।
কোরআনে করিমে মুনাফিকদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামে সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে, আর আপনি তাদের জন্য সাহায্যকারী হিসেবে কখনো কাউকে পাবেন না।’ সুরা নিসা : ১৪৫ (সংগৃহীত)