শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি। কালিগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের সাত বছরের শিশু খুকুমনির মেরুদন্ডের হাঁড় বেঁকে যাচ্ছে। আবার প্রচন্ড রাগ ছাড়াও রয়েছে অনেক বেশী জিদ। খাওয়ার ব্যাপারেও তীব্র অনীতা এ শিশুর। এমন নানান সমস্যাবলী নিয়ে কবিরাজ আজিজুর রহমানের দারস্থ হয় পরিবারের সদস্যরা। পর্যবেক্ষণ শেষে জানানো হয় উপরি (জীনের) সমস্যা রয়েছে তার। প্রতিকার হিসেবে মালিশের জন্য তেল পড়া আর কোমরে বাঁধতে দেয়া হয় মাদুলি। বিনিময়ে তিনশ এক টাকা নেয়া হয় খুকুমনির অভিভাবকের নিকট থেকে।
ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে নলতা গ্রামের এক কিশোরী বাড়ি ছেড়েছেন তিনদিন আগে। অবস্থান সনাক্ত করতে না পেরে নিরুপায় অভিভাবক ছুটে যান আজিজুরের কাছে। তবে কবিরাজের সহযোগীর পক্ষ থেকে জানানো হলো দুই হাজার টাকা হলেই মিলবে মেয়ের বাড়িতে ফিরে আসার ‘টোটকা’। তবে শুধুমাত্র এই দু’টি ঘটনা না। বরং মান অভিমান ও মনোমালিন্য থেকে শুরু করে শাররীক নানান জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা মেলে আজিজুর রহমানের চেম্বারে। শ্যামনগর উপজেলার পাশ্ববর্তী কালিগঞ্জের বাথুয়াডাঙা গ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী এ যুবকের দাবি জিনের সহায়তায় তিনি মানুষের চিকিৎসা সেবা দেন।
বাথুয়াডাঙা গ্রামে ঢুকে বামের ইটের সোলিং ধরে কিছুদুর এগুতেই ডান পাশের দ্বিতল ভবন দেখলেই ফুড়ে উঠে আভিজাত্যের ছাপ। চারপাশে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা মোড়ানো পরিবেশ নিশ্চিত করে নিরাপত্তার প্রশ্নে কতখানি তটস্থ কবিরাজ ও তার লোকজন। এলাকার কবিরাজ মহল হিসেবে পরিচিত বাড়িতে ঢুকে লোহার গ্রিল আটকানো বারান্দায় বসা ব্যক্তির নিকট ‘সিরিয়াল’ নেয়ার জন্য গুনতে হলো ১০ টাকা। প্রায় দুই ঘন্টা পর ডাক পেয়ে ভিতরে ঢুকতেই নাম-পরিচয় আর পিতা-মাতার নাম জেনে সামনে থাকা আয়না তুলে নিলেন তিনি। কিছুক্ষন পর জানালেন ‘অনেক জটিল ও কঠিন রোগের পুর্বাভাস রয়েছে। মুক্তির উপায় বাতলে দিয়ে অপর সহকর্মীকে দিয়ে তিনি আবারও পাঠিয়ে দিলেন বারান্দায় বসে ‘সিরিয়াল’ দেয়া ব্যক্তির কাছে। ভিতর থেকে আসা ফরমায়েসমত জানানো হলো গরুর এক বোতল টাটকা দুুধ আর দুই প্রকারের ফুল নিয়ে হাজির হতে হবে তিনদিনের মধ্যে। সেটা দিয়ে প্রস্তুতকৃত মাদুলি শরীরে বেধে রাখলে মিলবে জটিল সে রোগ থেকে মুক্তি।
প্রায় একই ধরনের চিকিৎসা দেয়া হলো ৫২ বছর বয়সী গৃহবধু সালেহাকে। সমস্যার কথা জানার পর তাকে জবাসহ পাঁচ প্রকারের টাটকা ফুল নিয়ে আসতে বলা হয় তৎক্ষনাত। সাথে একটি গোলাপ পানি, আর কিছু মোমম ও মাদুলি। এসময় কবিরাজের সহকারীরা জানিয়ে দেয় বাড়ির সামনের সড়কের ওপাশে মিলবে এসব উপকরণাদী। উপকরণ বিশেষ কমবেশী মুল্য পরিশোধের পর ‘টোটকা’ বানিয়ে দেয়ার পর তাদের দুই বোতল ঔষধের মুল্য ধার্য্য হলো সাতশ ২১ টাকা। আর এভাবে একের পর এক আগত রোগীদের চিকিৎসা মিললো কথিত কবিরাজ আজিজুরের আস্তানায়।
সুফিয়া খাতুন নামের এক নারী জানায় ফজরের আযানের পর তারা সেখানে পৌছেছেন। তবে প্রচন্ড ভিড়ের কারনে বেলা সাড়ে ১১টার কিছু আগে তার ডাক পড়ে। লোকমুখে শুনে তিনি তার পেট ও কোমরের ব্যাথার চিকিৎসা নিতে সেখানে এসেছেন বলে দাবি করেন। প্রায় অভিন্ন দাবি কবিরাজ আজিজুরের বাড়িতে ভিড় জমানো এমন শত শত রোগীর। সবারই প্রায় একই অভিব্যক্তি যে জীন ও পরীর সাহায্যে আজিজুর সবরোগের চিকিৎসা করেন। অনেকে তার চিকিৎসায় ভাল হয়েছেন- লোকমুখে এমন তথ্য পেয়ে দুর-দুরন্ত থেকে তারা সেখানে আসেন সেবা নিতে।
এদিকে এলাকাবাসীসহ কয়েকজন ভুক্তোভোগীর সাথে কথা বলে জানা যায় মাদ্রাসা পড়াকালীন ঝাঁড়ফুকের কাজ করতেন আজিজুর। একপর্যায়ে তাকে পরীতে উঠিয়ে নিয়ে যায় ‘গল্প’ ফেঁদে তিনি শুরু করেন কবিরাজী চিকিৎসা। আর এই কাজে পরিবারের ভাই ভাগ্নেসহ অসংখ্য দালাল নিযুক্ত করে রেখে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ফুলেফেঁপে উঠেছে গোটা পরিবার। একই এলাকার মৃত সাহামাত আলীর ছেলে আজিজুর তার অপর দুই ভাইসহ এই চক্র গড়ে তুলেছেন বলে নিশ্চিত করেন স্থানীয়রা। আর তারা প্রচার কাজে ব্যবহার করেন কবিরাজের মামা বাথুয়াডাঙার নজির আলী ও নারায়নপুর গ্রামের মিঠসহ আরও কয়েক দালালকে।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা বলেন মাত্র দেড় যুগ আগেও কৃষি শ্রমিক ও দিনমজুরের কাজ করতেন তার বড় ভাই ও পিতাসহ পরিবারের সদস্যরা। তবে ‘জীন-পরীর’ গল্প ফেঁদে সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে দিনের পর দিন প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অসংখ্য জটিল ও কঠিন রোগী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরানাপন্ন না হয়ে বরং আজিজুরের ফাঁদে পড়ে দিনকে দিন শারিরীক অবস্থাকে আরও কঠিন করে তুলছে। কয়েকজন ভুক্তোভোগী জানান আজিজুর অনেক রোগের চিকিৎসার্থে জ্যান্ত পাখি ব্যবহার করেন। কখনও কখনও জোড়া কবরের মাঝে মাদুলী পোঁতার মত ঘটনা ঘটিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে আজিজুরের মধ্যে।
ভুক্তোভোগীসহ এলাকার মানুষের দাবি চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোন ধারনা না থাকার পরও প্রতারনার ফাঁদ পেতে নিজে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে আজিজুর। পক্ষান্তরে গাছ-গাছড়া আর মাদুলী টোটকায় ভর করে ভুল চিকিৎসার শিকার অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত আরও অসুস্থ হচ্ছে। এমতাবস্থায় অতিসত্তর আজিজুর ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের আইনের আওতায় আনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রতারকচক্রের কবল থেকে মুক্তি দিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আজিজুর রহমান জানান জীন ও পরীর সাথে তার সখ্যতা রয়েছে। তিনি সব রোগের চিকিৎসা করেন না- জানিয়ে আরও বলেন অধিকাংশ রোগীকে পরীক্ষার পর তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে পাঠিয়ে থাকেন। কবিরাজী ব্যবসা না বরং জমি জায়গা চাষবাসসহ ঘের ব্যভসা করে অর্থকড়ি বানানোর দাবি করেন তিনি।