আলভী আহমেদ, বুটেক্স প্রতিনিধি
২২ জুলাই ২০২৪। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন, চারপাশ নিস্তব্ধ। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে উত্তাল দেশের শিক্ষার্থীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মন্তব্যে আগুনে ঘি পড়ে। রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।
এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে গ্রেফতার হন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৫০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোঃ হাসিবুর রহমান। মিরপুর মডেল থানা হয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে। ১৬ দিনের এই কারাবাস তার কাছে শুধুই বন্দিত্ব নয়, বরং ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র, স্বৈরাচার এবং নাগরিক স্বাধীনতার মধ্যকার এক নির্মম বাস্তবতা উপলব্ধির সময়।
একটি সাধারণ সন্ধ্যায় হাসিব বের হয়েছিলেন টাকা তুলতে। পথে হঠাৎ পুলিশ তার মোবাইল পরীক্ষা করে পায় আন্দোলনের ছবি ও ভিডিও। সঙ্গে সঙ্গে তাকে আটক করা হয়। “স্যার, পাইছি!” ওই পুলিশের সেই চিৎকার যেন শুরু করে তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
মিরপুর মডেল থানায় কাটানো সেই রাত ছিল বিভীষিকাময়। কেউ মুচলেকায় মুক্তি পায়, কেউ টাকার বিনিময়ে। আর কেউ, যেমন হাসিব, শুধু অপেক্ষা করে অনিশ্চিত পরিণতির। রাত ১টায় হাজতে ঢোকানো হয় তাকে। সহবন্দিদের কণ্ঠে বারবার শোনা যায় করুণ আকুতি “আমি নিরপরাধ, আমাকে ছেড়ে দিন!”
২৩ জুলাই, নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা প্রিজন ভ্যানে করে হাসিব পা রাখেন কেরানীগঞ্জ কারাগারে। জেল গেটে সব কিছু কেড়ে নেওয়া হয় টাকা, ফোন, আত্মমর্যাদা। এরপর শুরু হয় প্রকৃত বন্দিত্ব।
‘বনফুল’-এর ১৩ নম্বর রুম একটি ছোট সেল, পাঁচজন বন্দি, একটি ফ্যান, একটি মাত্র আলো, আর কোণায় নোংরা একটি টয়লেট। তার সহবন্দিরা রাফি, রহিত, মারুফ ও ইসমাইল সবাই কোনো না কোনোভাবে এই দমন-পীড়নের শিকার।
প্রথম দুই দিন খাবারই জোটেনি তার। পরে পরিবার থেকে পাঠানো টাকায় কিনতেন শুকনো খাবার। তাও পুলিশের ১০% কমিশন দিয়ে। দিনে ১ লিটারের বেশি পানি পান করাও ছিল কঠিন। গোসল করেছেন মাত্র একবার, আর দিনের আলো দেখেননি একবারও। কারাগারে ২৪ ঘণ্টা আলো জ্বলতো যেন অন্ধকারেও মুক্তি নেই।
৫ আগস্ট, সোমবার। গুঞ্জন ছড়ায় শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছেন। প্রথমে বিশ্বাস না করলেও সন্ধ্যার পরপরই নিশ্চিত হয় সারা দেশে ছাত্র আন্দোলনকারীদের জন্য রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে।
বনফুলের প্রতিটি সেলে ছড়িয়ে পড়ে উল্লাসের ঢেউ “আল্লাহু আকবার”, “জিয়ার সৈনিক এক হও” ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে কারাগারের দেয়াল। সেই রাতেই শুরু হয় মুক্তির প্রক্রিয়া। ১৬ দিনের কারাবাসের পর হাসিব জেলগেট পেরিয়ে আবার মুক্ত আকাশের নিচে।
মুক্তির পর হাসিব ফিরে যান সেই মিরপুর থানায়, যেখানে তাকে প্রথমবার আটক করা হয়েছিল। একসময় যেখান থেকে পুলিশ তুলে নিয়েছিল, এখন সেখানে ছাত্ররাই পাহারায়, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে।
হাসিব মনে করেন, সত্যিকারের পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন মানুষ নিজের নৈতিক দায়িত্বে অটল থাকবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেবল কাগজে নয়, বাস্তবেও নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশি হয়রানি, রাজনৈতিক প্রভাব ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য দূর না হলে স্বাধীনতা কেবলই এক বিভ্রম হয়ে থাকবে।
হাসিবের এই গল্প কেবল একজন তরুণের অভিজ্ঞতা নয়, বরং এটি একটি সময়ের দলিল, একটি আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যকার বিশ্বাসের সংকট এবং সম্ভাবনার বাস্তব পরীক্ষা এই অভিজ্ঞতা।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রয়োজন দায়িত্বশীল নাগরিক, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, এবং মানবাধিকারের প্রতি অটল শ্রদ্ধা। হাসিবের মতো তরুণদের অভিজ্ঞতা যেন ভুলে না যাই কারণ এই স্মৃতিই আমাদের পথ দেখায়।