ইউনিয়ন পরিষদের দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের প্রায় ৪২ শতাংশই হেরে গেছেন। নানা কারণে পরিস্থিতি অনুকূল থাকার পরও এই প্রতীকের প্রার্থীদের একটি বড় অংশের পরাজয় সরকারি দলের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দল থেকে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়ার কারণেই এমন ফল হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ৫৮.২৭ শতাংশ জয়ী হয়েছে। বাকি ৪১.৭৩ শতাংশ নৌকার প্রার্থী নিজ দলের বিদ্রোহী ও বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরেছেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে এই হিসাব পাওয়া গেছে।
এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ৩৯.৫৬ শতাংশ। তাঁদের মধ্যে বিএনপি নেতারাও আছেন। বিএনপি দলীয়ভাবে এই নির্বাচনে অংশ না নিলেও নেতাদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের অনুমতি দিয়েছে। বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ের হিসাব আলাদাভাবে জানা যায়নি। তবে এই সংখ্যা ৫০-এর ওপর বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুসারে প্রথম ধাপের তুলনায় দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ভালো করতে পারেননি। দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৪টি ইউপির মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ৪৮৬টিতে। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৮১ জন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪০৫ জন জয়ী হন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ৩৩০টিতে।
এ ছাড়া এই ধাপে জাতীয় পার্টি ১০টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চারটি এবং জাতীয় পার্টি (জেপি), খেলাফত মজলিশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি একটি করে ইউপিতে জয়ী হয়েছে।
এর আগে প্রথম ধাপে দুই দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ৭৩.৪৮ শতাংশ ইউপিতে জয়ী হন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন ২৪.২২ শতাংশ ইউপিতে। ওই নির্বাচনে ৩৬৫টি ইউপির মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ২৬৯টিতে জয়ী হন। এর মধ্যে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৭২টি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৯৭টিতে জয়ী হন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন ৮৮টি ইউপিতে।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টি তিনটি, জাতীয় পার্টি (জেপি) তিনটি এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি একটি করে ইউপিতে জয়ী হয়।
বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন এমন ইউপিগুলোর মধ্যে রয়েছে রংপুরের পীরগাছা সদর, ছাওলা ও কান্দি; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ধরমণ্ডল, কুণ্ডা ও গোকর্ণ; যশোর চৌগাছার পাতিবিলা ও হাকিমপুর; মৌলভীবাজারের জুড়ীর জায়ফরনগর ও গোয়ালবাড়ী; পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার তিরনইহাট, বুড়াবুড়ি ও ভজনপুর এবং দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের নাফানগর ও মুর্শিদহাট।
আবার কয়েকটি ইউপিতে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী মনোনয়ন না দিয়ে দলের সবার জন্য উন্মুক্ত রাখে। দ্বিতীয় ধাপের গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার সাতটি ইউপি এভাবে উন্মুক্ত রাখা হয়। এসব ইউপিতে নৌকা প্রতীক কাউকেই দেওয়া হয়নি। তবে এই উপজেলার অন্য সাতটি ইউপিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু পাঁচটিতেই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে তাঁরা হেরেছেন।
গত মাসে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর প্রায় ২০০ ইউপির মনোনয়ন পরিবর্তনের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবর আবেদন করেন স্থানীয় নেতারা। আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, আট বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও এসব আবেদন আসে। তখনই আভাস মিলেছিল, প্রার্থী পরিবর্তন না হলে অনেক ইউপিতে নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে বিদ্রোহী নেতাদের দেখা যেতে পারে।
গাইবান্ধার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র তিনটিতে নৌকার প্রার্থী জিতেছেন। একটিতে জিতেছে জামায়াত। বাকিগুলোতে স্বতন্ত্র। ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটিতেই হেরেছেন নৌকার প্রার্থী। এক ইউপির নির্বাচন স্থগিত হয়েছে। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের মাত্র একটিতে জিতেছে নৌকার প্রার্থী। নীলফামারীতে ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে দুই, জুড়ী গ্রামের ভূরুঙ্গামারীর সাতটি ইউপির মধ্যে দুটিতে জিতেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী।
নির্বাচনের ফলকে কিভাবে দেখছে—জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পক্ষে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ সবাই কাজ করে থাকে বলে অভিযোগ আছে। তার পরও তাঁদের অনেকের নির্বাচনে হেরে যাওয়াটা কারো কারো কাছে বিস্ময়ের। কিন্তু আমি বিস্মিত নই। এ ধরনের ঘটনা সামনে আরো বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘এসব প্রার্থীর হেরে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে ভোটারদের কাছে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই কম। অনেক ক্ষেত্রে যাঁরা টাকা দিতে পেরেছেন, চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছেন তাঁরাই মনোনয়ন পেয়েছেন। যোগ্য অনেকে মনোনয়ন পাননি। এর মাধ্যমে দলে শৃঙ্খলা, গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়ানোর বার্তাই মিলছে। ভোটের ফলাফলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মাত্র।’ কালের কন্ঠ