।।মোঃ মাসুম বিল্লাহ ।।
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সংস্কার মুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশর একটি নতুন বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত। তেমনি নতুন বন্দোবস্ত নারী সংস্কার কমিশন। নারী সংস্কার কমিশনের সিদ্ধান্তগুলো যদি আমাদের সমাজে বাস্তবায়িত হয় তাহলে সামাজিক মূল্যবোধের মূলে আঘাত পড়বে, সমাজব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। এর ফলে সামাজিক বিধি নিষেধ এর তোয়াক্কা না করে মানুষ যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হবে। এদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। তাদের রক্তের সাথে মিশে আছে ধর্মের প্রতি আনুগত্যশীলতা। ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে তারা পরিচালিত হতে পছন্দ করে। ধর্মীয় আইন মানতে তাদের স্বাচ্ছন্দ বোধ হয়। ধর্মের ভয়ে ভীত হয়ে এদেশের মানুষ যত বেশি অন্যায় কর্ম থেকে বিরত থাকে রাষ্ট্রীয় আইনে তা দেখা যায় না। এদেশের মানুষ ধর্ম দিয়ে নিজেদের জীবন পরিচালনা করে। কিন্তু এই সংস্কার কমিশন এমন কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যা ধর্মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবে।
সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রশ্নে এদেশের প্রগতিশীল নারীবাদীরা অনেকদিন থেকে সোচ্চার। তারা মনে করেন নারীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নারীদেরকে ঠকানো হচ্ছে। এজন্য তারা সম্পত্তিতে সমান অধিকার চেয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। সম্পত্তিতে সমান অধিকার থাকবে কি থাকবে না এটা একটা বিতর্কের বিষয় হতে পারে। এ বিষয়ে ধর্মের একটা সুন্দর ব্যাখ্যা রয়েছে। ধর্মের ব্যাখ্যাটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ইসলামিক দৃষ্টিতে। এটি একমাত্র গ্রহণযোগ্য কেননা ইসলাম হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবন বিধান। সুতরাং ইসলাম ধর্মের অনুসারী যারা ইসলামকে ভালোবাসে বা যারা মুসলমান তাদের কাছে ইসলামের বিধান; আল্লাহর বিধান এর বাইরে চিন্তা করার কোন সুযোগ নেই, বিশ্বাস করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং মুসলমান হিসেবে এটা বিশ্বাস করতে হবে ধর্মের বিধান এটা আপনারেআমার জন্য কল্যাণকর। কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষদের নিয়ে। এদেশের মানুষ যতটা না ধর্মকে পালন করতে চাই তার থেকে তারা অনেক বেশি ধর্মীয় গোড়ামীটাকে লালন করে। যার ফলে তারা ধর্মের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান না। এজন্য যুগে যুগে তারা ইসলাম থেকে আলাদা হয়ে মানুষের মুক্তির জন্য ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। প্রগতিশীল এক শ্রেণীর লোক তারা প্রগতির কথা বলে ধর্মটাকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য ধর্মকে ব্যবচ্ছেদ করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির
বাস্তবায়ন এ দেশে ঘটানো। তারা মনে করেন যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি তাদের মুক্তি দিতে পারে। ঘুণে ধরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্রভাবে সেদেশের মানুষের জীবনে যে সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের ভাঙ্গন ডেকে এনেছে। তারা মাইকেল মধুসূদন দত্তের ইয়ং বেঙ্গলের অনুসরণ করার মত অনুকরণ করে শান্তি খুঁজেন। কিন্তু মধুসূদন তার ভুল বুঝেছিলেন। আমাদের দেশের এই প্রগতিশীল ব্যক্তিরা তারা ভুল স্বীকার করেন না। তারা নিজেদেরকে ধর্মের খোলস মুক্ত করে গণতন্ত্র মনা প্রগতিশীল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর। যার ফলশ্রুতিতে
আজকে নারী কমিশন গঠিত এবং এর সিদ্ধান্ত এদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সাদা চোখে দেখলে নারী সংস্কার কমিশন গঠন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এখানে আমাদের কোন বিরোধ থাকার কথা নয়। কিন্তু এই সংস্কার কমিশনের মধ্য দিয়ে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ, সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ, নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে নীল নকশা বাস্তবায়ন করতে চান তা আমাদের বিরোধিতার জায়গা তৈরি করছে। কমিশনের সিদ্ধান্তে যৌন কর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিধান উঠে এসেছে।বলেছেন তাদেরকে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে অর্থাৎ যৌন কর্মের সাথে নিয়োজিত ব্যক্তিরা শ্রমিকের মর্যাদা পাবে। আমরা যেমন কর্মের বিনিময়ে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকি ঠিক তেমনি তারা এ কর্মের বিনিময়ে পারিশ্রমিক পাবেন। সমস্যাটা বাধে এখানে। এই যৌন কর্মটাকে আমাদের সমাজে ঘৃণিত, নিষিদ্ধ, বিবাহ বহির্ভূত ব্যাভিচার ও নিন্দনীয় কর্ম হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সমাজের অবজ্ঞার পাত্র হিসেবে পরিচিত হন। সামাজিক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে তারা একটা সুন্দর জীবন যাপন করতে পারেন না। তাদের এই হীনকর্ম সামাজিক সম্পর্কের বাইরে অবৈধ্য উপায়ে হওয়ায় তাদের অমর্যাদার কারণ হয় ।
যৌন কর্মীদের সামাজিকভাবে অপরাধের চোখে দেখা হয়। কিন্তু তারা যদি শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি পায় তাহলে তারা এই কাজ করতে আর দ্বিধাবোধ করবে না। তারা মনে করবে আমরা কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করছি। সুতরাং এরকম হীন কর্মকাণ্ডে বা কাজে আসার প্রবণতা বাড়বে। এমনকি মানুষ কষ্টলব্ধ কাজ ছেড়ে আপনার আমার সংসারের মা,বোন,স্ত্রী, কন্যা এই পেশায় আশটাকে স্বাভাবিক মনে করবে। অনেকে এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবে যা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের একটা বড় কারণ হবে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ককে ব্যভিচার বলা হয়। ব্যভিচারের শাস্তি ধর্মীয় দৃষ্টিতে কঠোর। কিন্তু সামাজিকভাবে আমাদের দেশে এরকম কর্মের সাথে যারা নিয়োজিত থাকেন তাদেরকে ঘৃণিত হয় থাকার পথ বদ্ধ হবে।
কেননা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একটা মূল্যবোধের চর্চা হয়। সে মূল্যবোধটি ভেঙ্গে যাবে। যদি এরকম স্বীকৃতি দেওয়া হয় তবে অনেক মানুষ নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন, স্বার্থ হাসিল বা আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য এরকম ঘৃণিত কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে মর্যাদা বোধ করবেন। আর আপনি তাকে বলতে পারবেন না যে এই কাজটি খারাপ। ধর্মীয়ভাবে বলতে পারবেন না, সামাজিকভাবেও বলতে পারবেন না। রাষ্ট্র এরকম কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে সমাজে সেটা স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হওয়া। আর সমাজ স্বীকৃত পন্থা যদি এটা হয়ে যায় তাহলে আমাদের দেশের
সামাজিক ও পারিবারিক ভাঙ্গন তৈরি হবে। পরিবার বলে কিছু থাকবে না। পারিবারিক মূল্যবোধ বলে কিছু থাকবে না। ধর্মীয় মূল্যবোধ বলে কিছু থাকবে না। যথেচ্ছাচার পরিণত হবে মানুষের জীবন।
এটা অনেক বেশি নারীর জন্য ক্ষতির কারণ হবে। এছাড়া এই যে যৌন কর্মীদের শ্রমিক হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার যে স্বীকৃতি তারা চেয়েছে আমাদের ধারণা হয়তো তারা কোন যৌনকর্মীর সাথে কথা বলেনি। তাদের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করেন নি যে, তারা কি চায়। এরকম কর্মে যারা নিয়োজিত তারা কখনো নিজেদেরকে সে পেশায় নিয়োজিত রেখে গর্ববোধ করেন না। বরং তারা সে পেশা থেকে মুক্তি চান। তারা নিজের সন্তানকে কখনো সে পেশায় আনতে চান না। সব সময় চেয়েছেন তারা নিজেরা সে পথ থেকে ফিরে এসে একটা ভালো সামাজিক বন্ধন যুক্ত জীবন যাপন করতে। তারা চেয়েছে তাদের সন্তান সে জায়গা থেকে চলে এসে সামাজে একটা সুস্থ জীবন যাপন করুক। কোন যৌন কর্মীকে এ পর্যন্ত দেখা যায়নি তারা বলে আমার সন্তান এই কাজে নিয়োজিত হবে বা তাদের
ইচ্ছা যে তার সন্তানকে এই কাজে নিয়োজিত করবে। বরং তারা এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি চায়।
এ সংস্কার কমিশনে যারা রয়েছেন তারা কিসের ভিত্তিতে কোন মানদন্ডের ভিত্তিতে এরকম হীন কর্মটাকে স্বীকৃতি দিতে চান? এটা যদি তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অভিলাষকে বাস্তবায়নের জন্য হয়ে থাকে তাহলে সেটা এদেশে কার্যকর হবে না। এটা এদেশের সামাজিক মূল্যবোধ ভাঙ্গন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অবজ্ঞার শামিল। সুতরাং এরকম হীন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের যে পন্থা নারী সংস্কার কমিশন এনেছেন সেটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আমাদের সমাজ আমাদের পরিবার আর টিকবে না। আমরা একটা সময় আমাদের নিজেদের সন্তানকে রক্ষা করতে পারবো না।
পাশ্চাত্যের মতো স্কুলের গন্ডি না ছাড়াতে আমাদের সন্তান ভার্জিনত্ব হারাবে। তাদের সম্ভ্রমহানি হবে এবং নিজেরা সম্মানের সহিত জীবন যাপন করতে পারবে না। এমনকি এই পেশার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা কখনো এ পথ থেকে ফিরে আসার জন্য আর চেষ্টাও করবে না। কেননা তারা এর মধ্য দিয়ে নিজের আর্থিক অবস্থাটাকে পরিবর্তন করতে চাইবে। কারণ তারা সেটাকে পেশা বা কাজ মনে করবে। এজন্য এই ঘৃণিত কাজটা থেকে আমরা আমাদের সমাজকে ফেরাতে পারবো না। তাই এখনই সময় আমাদের সকলের সোচ্চার হওয়ার এবং যে মহল এটি বাস্তবায়ন
করতে যাচ্ছে তাদের এদেশের মানুষের মুল্যবোধকে বোঝা উচিত।
যে নারীর সংস্কার কমিশন এটি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে তারা প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের সাথে কথা বলেছে বলে মনে হয় না। তারা শহরকেন্দ্রীক কিছু এলিট শ্রেণীর প্রগতিশীল ক্লাবে পার্টি করা মহিলাদের মতামতকে সমগ্র জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন। কিন্তু তারা যদি গ্রামে গ্রামে ঘুরে আমাদের মা বোনদের সাথে কথা বলে, তাদের থেকে প্রতিনিধি নিয়ে তাদের মতামত সংগ্রহ করলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামের প্রত্যেকটা নারী তারা ধর্মপ্রাণ। ধর্মকে সম্মান করে। পরিবারকে ভালোবাসে। তারা সামাজিক বিধি-নিষেধকে মেনে চলে সামাজিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু এর ফলে যৌবিক চাহিদা মেটানোর সমাজ স্বীকৃত পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে যাবে। কেননা তাদের যৌবিক চাহিদা মেটানোর পথ প্রসারিত হবে। ফলে পরিবার, সন্তানের প্রতি দায়বদ্ধতা শিথিল হবে। এরকম কর্মের মধ্যে দিয়ে নারীদের অসম্মানের পথ প্রসারিত হবে। শহরকেন্দ্রিক মানুষগুলোর চিন্তা-ভাবনা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিলে ভুল হবে। কেননা আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। আর এই গ্রামের মানুষের চিন্তা ভাবনা ও গ্রামের নারীদের চিন্তাভাবনার সাথে আমাদের একিভূত হতে
না পারলে এ দেশের কখনো উন্নতি হবে না। তবু মনে শংকা জাগে এমন পরিকল্পনা এদেশ কখনো
আলোর মুখ দেখবে কী?