ডেস্ক নিউজ।
ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের এক ছোট্ট গ্রাম উত্তাওয়ারে আজও শীতের এক রাতের স্মৃতি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে আসে। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরের সেই রাতে সরকারি নির্দেশে গ্রামের প্রজননক্ষম পুরুষদের জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বন্ধ্যাকরণ শিবিরে। সেসময় দেশজুড়ে চলছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষিত জরুরি অবস্থা, যার আওতায় লাখ লাখ মানুষ হয়ে উঠেছিল সরকারের ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’ অভিযানের লক্ষ্যবস্তু।
উত্তাওয়ার গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ দীনু জানান, কীভাবে তাঁকে ও তাঁর ১৪ জন বন্ধুকে পুলিশ তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। দীনু বলেন, “সবাই যখন পালাচ্ছিল, তখন আমরা গ্রামকে বাঁচানোর জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছিলাম।” তবে সেই ‘ত্যাগ’ গ্রামবাসীর জন্য ভবিষ্যতে বয়ে আনে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক কলঙ্ক ও মানসিক আঘাত।
ইন্দিরা সরকারের অধীনে চালানো এই কর্মসূচিতে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে ৮০ লাখেরও বেশি পুরুষকে জোর করে বন্ধ্যাকরণ করা হয়। শুধু ১৯৭৬ সালেই সংখ্যাটি ছিল ৬০ লাখ। বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে ৬৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য সাহায্যের শর্ত হিসেবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি চায়। এ সময় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বন্ধ্যাকরণ কোটা পূরণের চাপে পড়েন। অনেকে কোটা না পূরণ করলে চাকরি হারানোর হুমকি পান, এমনকি গ্রামের পানি-সেচও বন্ধ করা হয়।
স্থানীয়দের ভাষায়, ‘ভয়ের রাত’ নামে খ্যাত সেই অভিযানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তাওয়ার গ্রাম ছিল বিশেষ নজরদারিতে। মোহাম্মদ নূর, যিনি সে সময় কিশোর ছিলেন, স্মরণ করেন কিভাবে পুলিশ তাদের ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে ধ্বংস করে এবং খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে বালু মিশিয়ে দেয়।
ঘটনার সামাজিক প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, পরবর্তী কয়েক বছর উত্তাওয়ার গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে আশপাশের গ্রামে বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি যারা বন্ধ্যাকরণ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও বিয়ে নিয়ে সমস্যা হয়।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে, উত্তাওয়ারের তৎকালীন গ্রামপ্রধান আব্দুর রহমান সরকারি চাপে মাথা নত না করে বলেছিলেন, “আমি আমার এলাকা থেকে একটা কুকুরও দেব না, আর তোমরা মানুষের দাবি করছ!” তবু, তাঁর এই প্রতিরোধ শেষ পর্যন্ত গ্রামবাসীদের রক্ষা করতে পারেনি।
সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথনের মতে, এই ঘটনাই ভারতের আধুনিক কর্তৃত্ববাদের ভিত্তি স্থাপন করে। তিনি বলেন, “জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদ স্বাভাবিক হয়ে যায়, যা আজকের ভারতেও তার প্রতিফলন রাখছে।”
‘ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা গীতা শেঠুর মতে, বর্তমানে গণমাধ্যমের ভূমিকা, ভয় আর আত্মনিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সেই সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। সাংবাদিক আসিম আলী প্রশ্ন তোলেন—“মোদির পরেও কি ভারত আবার গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পারবে?” সূত্র -বিবিসি