মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক।
এ বিশ্বের উন্নতি ও সমৃদ্ধি ইলমের বিস্তারে এবং ধ্বংস অজ্ঞতার প্রসারে। যখন কোন শহর কিংবা অঞ্চলে দ্বীনি ইলমের ব্যাপক বিস্তার ঘটে তখন তার অধিবাসীদের মাঝে অন্যায়-পাপাচার হ্রাস পায়। পক্ষান্তরে সেখানে দ্বীনি ইলম প্রচ্ছন্ন বা গৌণ হয়ে পড়লে তথাকার জনগণের মধ্যে অন্যায় অরাজকতা বাড়তে থাকে। তাদের গতি হয়ে পড়ে স্থবির। দ্বীনি কাজের নামে তারা জড়িয়ে পড়ে নানা বিদ‘আত ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতিতে। যে একথা অনুধাবনে ব্যর্থ সে ঐসব লোকের অন্তর্ভুক্ত যাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা কোন আলো রাখেননি।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেছেন, ইলম যদি না থাকত তাহ’লে মানুষ পশুর মত হয়ে যেত। তিনি আরও বলেছেন,الناس مُحْتَاجُون إلى العِلْم أكثر مِن حاجتهم إلى الطعام والشراب؛ لأن الطعام والشراب يُحْتَاج إليه في اليوم مرة أو مرتين، والعِلْم يُحْتَاج إليه بِعَدَد الأنفاس ‘মানুষের পানাহারের চেয়ে জ্ঞানের প্রয়োজন অধিক। কারণ খাদ্য ও পানীয় দিনে একবার বা দু’বার প্রয়োজন। আর জ্ঞানের প্রয়োজন শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা পরিমাণ’।[1]
ঈমান-আক্বীদা, ইবাদত-বন্দেগী, হালাল-হারাম, পাপ-পুণ্য, আল্লাহর হক, বান্দার হক, অন্যান্য মাখলূকের হক ও চারিত্রিক ভালো-মন্দের বিদ্যার্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয। তাছাড়া দায়িত্ব ও পেশার আলোকে প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে যে দ্বীনি বিধি-বিধান বিশেষভাবে জড়িত সে জাতীয় বিদ্যা শিক্ষা তার উপর ফরয। তার প্রয়োজন নেই এমন বিদ্যা শিক্ষা করা তার উপর ফরয নয়। তবে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যকীয় বিদ্যা শিক্ষা করা ফরযে কিফায়া বা সামষ্টিক ফরয। ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ছিলেন সর্বাধিক সৎপথ প্রাপ্ত বিদ্বান। তাদের বিদ্যার ধুলোবালিও আমাদের আছে কি-না সন্দেহ। তথাপি তারা বিদ্যার্জনের সাথে জীবিকা সংগ্রহের কাজও করতেন। তারা চাষাবাদ, পশুপালন, ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যবসা উপলক্ষে দেশ-বিদেশ সফর এবং হাটে-বাজারে বেচা-কেনা করতেন। এর মধ্যেই তারা দ্বীনি ইলম শিখতেন এবং যেখানেই থাকুন এই বিদ্যাযোগে মানুষের মাঝে জোরেশোরে ইসলাম প্রচার করতেন। মানুষের জীবনে দ্বীন এক নম্বর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই এক্ষেত্রে দ্বীনি ইলম না শিখে অন্য সকল বিদ্যা শিখব আর দ্বীনের ক্ষেত্রে এ অজুহাত সে অজুহাত পেশ করব, তা তো কোন বিজ্ঞ মানুষের কথা হ’তে পারে না। আমল শুরুর আগে দরকার তৎসম্পর্কিত ইলম। ধর্মীয়, দৈহিক, মানসিক, আর্থিক, বৈষয়িক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে উন্নতি করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ইলম অর্জন একান্তই প্রয়োজন।
ইসলাম একটি জীবন ব্যবস্থার নাম। মুসলিম হিসাবে বেঁচে থাকতে এবং জীবন-যাপন করতে চাইলে ইসলাম সংক্রান্ত বিদ্যার্জন ফরয। আরবী ‘ফরয’ শব্দের অর্থ ‘আবশ্যিক’। ফরয আবার দু’ভাগে বিভক্ত। ফরযে কিফায়া ও ফরযে আইন। ফরযে কিফায়া সমষ্টিগত ফরযকে বলে এবং ফরযে আইন ব্যক্তিগত ফরযকে বলে। ইসলামী বিধি-বিধান অনুযায়ী জীবন-জীবিকার বিষয়সমূহ, মুসলিম মিল্লাত, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনার জন্য যে ইলম না জানলে এগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে তা জানা ফরযে কিফায়াহ। অনেকটা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের এ ইলম। সমাজের আবশ্যকীয় পরিমাণ মানুষকে এ বিদ্যা শিখতেই হবে, প্রত্যেককে শিখতে হবে না। নানা শ্রেণীর মানুষ বিভিন্ন বৃত্তি-পেশার মাধ্যমে এ ফরয আঞ্জাম দিয়ে চলেছে। পক্ষান্তরে যে ইলম ইসলামী বিধি-বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ব্যক্তিগত জীবন নির্বাহের জন্য আবশ্যক তা অর্জন ফরযে আইন। এ বিদ্যা মুসলিম নর-নারী মাত্রেই শিখতে হবে। এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে- একজন মুসলিমের ইসলাম মেনে জীবন যাপনের জন্য কতটুকু বিদ্যার্জন ফরযে আইন? এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনু আব্দিল বার্র তার ‘জামিউ বায়ানিল ইলমী ওয়া ফাযলিহি’ গ্রন্থে বলেছেন,قَدْ أَجْمَعَ الْعُلَمَاءُ عَلَى أَنَّ مِنَ الْعِلْمِ مَا هُوَ فَرْضٌ مُتَعَيَّنٌ عَلَى كُلِّ امْرِئٍ فِي خَاصَّةِ نَفْسِهِ وَمِنْهُ مَا هُوَ فَرْضٌ عَلَى الْكِفَايَةِ إِذَا قَامَ بِهِ قَائِمٌ سَقَطَ فَرْضُهُ عَنْ أَهْلِ ذَلِكَ الْمَوْضِعِ ‘বিদ্বানগণ এ কথায় একমত যে, এক ধরনের ইলম রয়েছে যা ফরযে আইন, প্রত্যেক মুসলিমকে তা শিখতে হবে। আরেক ধরনের ইলম রয়েছে যা শেখা ফরযে কিফায়াহ বা সমষ্টিগত ফরয। কোন স্থানের কেউ একজন তা শিখলে ঐ স্থানের সকল বাসিন্দার উপর থেকে ঐ ফরয রহিত হয়ে যাবে।[2]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ফরযে আইন ইলম হ’ল- ১. ঈমানের উছূল তথা মূলনীতিগুলো জানা, ২. ইসলামী শরী‘আতের ইলম। যেমন- ওযূ, ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি, ৩. ইসলামের হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর জ্ঞান, ৪. মু‘আমালাত ও মু‘আশারাতের ইলম।[3]
তিনি শাফেঈ মাযহাবের আল্লামা আব্দুল বাসেত্ব ইবনু মূসা আলমাভী দিমাশকীর ‘আল-ইকদুত তালীদ’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেছেন, ‘কালিমায়ে শাহাদাহ উচ্চারণ ও তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার সত্যতা জ্ঞাপন করা এবং তার প্রতি সনেদহমুক্ত ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বিশ্বাস বজায় রাখাই ঈমান সংক্রান্ত আক্বীদার ক্ষেত্রে যথেষ্ট। ঈমানের ছয়টি বিষয়ের দলীল-প্রমাণ দাখিল করা এখানে যরূরী নয়। কেননা মহানবী (ছাঃ) ইসলাম গ্রহণকালে আল্লাহর তাওহীদ ও তাঁর নবুঅতের প্রতি শাহাদাহ বা সাক্ষ্য উচ্চারণ ছাড়া আর কিছু তলব করতেন না। এ বিষয়ে আমাদের সালাফ, ফক্বীহবৃন্দ ও অনুসন্ধানকারী আলেমগণ একমত বলে তিনি যোগ করেছেন’।[4]
তারপর তিনি বলেছেন, একজন মুসলিমের উপর যে পরিমাণ বিদ্যার্জন ফরযে আইন তাহ’ল : তাওহীদ বা আল্লাহ তা‘আলার একত্ব সংক্রান্ত ইলম। যেমন মুখে সাক্ষ্যদান ও অন্তর থেকে স্বীকৃতিদান যে, আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁর সদৃশ কেউ নেই, সমতুল্য কেউ নেই। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, কারও থেকে জন্ম নেননি এবং কেউ তাঁর সমকক্ষ নেই। তিনি সব কিছুর স্রষ্টা, তাঁর কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে। তিনি জীবিতকারী এবং মৃত্যুদানকারী, তিনি চিরজীবী, তাঁর মৃত্যু নেই। দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সব কিছুই তাঁর জানা, উভয়ই তাঁর কাছে সমান। আসমান-যমীনের কিছুমাত্র তার কাছে লুকায়িত নেই। তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশ্য, তিনিই গুপ্ত। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল, তিনি তাঁর গুণাবলী ও নামসমূহের সাথে অনুক্ষণ বিদ্যমান। তাঁর প্রথমত্বের যেমন সূচনা নেই তেমনি তাঁর শেষত্বের কোন অন্ত নেই।
একই সঙ্গে তাকে সাক্ষ্য দিতে হবে যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা, রাসূল এবং শেষ নবী। আরও সাক্ষ্য দিতে হবে যে, আমলের প্রতিফল দানের জন্য মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ঘটবে এবং সেখানে সৎকর্মশীল সৌভাগ্যবান মুমিনগণ চিরস্থায়ী জান্নাতী হবে এবং কাফির দুর্ভাগা যারা আল্লাহর বিধান থোড়াই পরোয়াকারী তারা জাহান্নামী হবে। এ সবই হক ও সত্য।
তাকে এ সাক্ষ্য দিতে হবে যে, কুরআন আল্লাহর বাণী। তার মধ্যে বর্ণিত সকল কথা আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সত্য। তার সব কিছুর উপর ঈমান রাখা অপরিহার্য এবং তার সুস্পষ্ট বিধি-বিধান অনুযায়ী আমল করতে হবে।
তাকে এ বিশ্বাস করতে হবে যে, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় ফরয। যেসব কিছু না হ’লে ছালাত পরিপূর্ণ হবে না সেসব বিষয় জানা ফরয। যেমন তাহারাত ও ছালাতের সকল হুকুম-আহকাম।
তাকে এ সাক্ষ্য দিতে হবে যে, রামাযানের ছিয়াম ফরয। যা না হ’লে ছিয়াম পূর্ণতা পাবে না এবং যা যা করলে ছিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে তার সবই জানা ফরয।
অর্থশালী হ’লে তার উপর যাকাতের নিয়ম-কানূন শেখা ফরয। কখন তা ফরয হবে, কোন কোন সম্পদে ফরয হবে, কতটুকু বা কি পরিমাণ ফরয হবে, কাদের মধ্যে কিভাবে বণ্টন করতে হবে, কিভাবে নিয়ত করতে হবে ইত্যাদির ইলম তাকে অবশ্যই জানতে হবে। হজ্জ ফরয হ’লে তাকে হজ্জের নিয়ম-কানূন সংক্রান্ত ইলম শিখতে হবে।
তাকে হারাম ও মাকরূহ বিষয়াবলী সম্পর্কিত বিদ্যা জানতে হবে, যাতে সেসব থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। যেমন যিনা-ব্যভিচার, মদ পান, শূকরের গোশত খাওয়া, মৃত প্রাণীর গোশত খাওয়া, সকল প্রকার নাজাসাত, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সূদ ও ঘুষ খাওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, লোকের সম্পদ অন্যায়ভাবে তার অসন্তুষ্টিক্রমে খাওয়া, যেকোন প্রকার যুলুম-নির্যাতন করা (আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা কিছু করতে নিষেধ করেছেন তা করলে যুলুম করা হবে)। মা, বোন, মেয়ে ও তাদের সাথে উল্লিখিত মহিলাদের বিবাহ করা, অন্যায়ভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করা, এমনিতর যা কিছু কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মাতের ইজমা মূলে হারাম কিংবা মাকরূহ সেগুলোর বিদ্যার্জন করতে হবে। এমনিভাবে ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকল বিষয় তাকে জানতে হবে। আল্লামা ইবনু আব্দিল বার্র-এর কথা এখানেই শেষ।
ইমাম নববী (রহঃ) তার ‘রওযাতুত ত্বালেবীন’ গ্রন্থে বলেছেন, কিছু বিদ্যার্জন ফরযে আইন এবং কিছু বিদ্যার্জন ফরযে কিফায়াহ। দ্বীনের যে সকল বিষয় ব্যক্তির উপর ফরয সেগুলো কার্যকর করার জন্য যেসব বিদ্যা জানা প্রয়োজন সেগুলো অর্জন করাও ফরযে আইন।[5] যেমন ওযূ, ছালাত, ছিয়াম ইত্যাদি। কেননা যিনি ছালাতের শর্তাদি ও রুকনসমূহ জানবেন না তার পক্ষে ছালাত আদায় সম্ভব হবে না। এখানে কেবলমাত্র বাহ্যিক বা দৃশ্যমান হুকুম-আহকাম জানার কথা বলা হচ্ছে। সেসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বা খুঁটিনাটি মাসআলা-মাসায়েল নয়, যা সাধারণ মানুষের জানার দরকার পড়ে না।
যদি তার যাকাত দেওয়ার মতো সম্পদ থাকে তবে তাকে যাকাতের বাহ্যিক বিধি-বিধান জানতে হবে।
আর যিনি বেচাকেনা তথা ব্যবসায়ে জড়িত তাকে ব্যবসায়ের বিধি-বিধান জানতে হবে। এমনিভাবে যিনি যে পেশায় যুক্ত তাকে সেই পেশার মাসআলা-মাসায়েল জানতে হবে। এখানেও বাহ্যিক মাসআলা-মাসায়েল বা বিধি-বিধান জানা উদ্দেশ্য। ইমাম নবভীর কথা এখানেই শেষ।[6]
সম্মানিত লেখকগণ ঈমান-আক্বীদা, ইবাদত-বন্দেগী ও পেশাগত আমলের কথা বলেছেন। আমরা তৎসঙ্গে হাক্কুল ইবাদ তথা মানুষের অধিকার, আদব-আখলাক বা আচার-ব্যবহারগত বিদ্যা এবং হালাল-হারাম শেখা যে যরূরী সে কথাও বলতে চাই। কেননা এগুলোর সাথেও ফরযে আইন জড়িয়ে আছে।
আমাদের সমাজে ফরযে আইন পরিমাণ বিদ্যা জানার হাল-হাক্বীক্বত কেমন কী রয়েছে তা একটু সংক্ষেপে তুলে ধরা যাক।-
এ সমাজে আমাদের জন্ম, এ সমাজেই আমরা বেড়ে উঠি। সমাজের সুযোগ-সুবিধা যেমন আমরা পেয়েছি এবং পাচ্ছি, তেমনি সমাজের যা দেওয়ার ছিল কিন্তু দেয়নি তাও আমরা জানি। এমনই একটি বিষয় যা আমাদের পরিবার ও সমাজ মোটেও গ্রাহ্য করে না বা আবশ্যিক বলে মনে করে না তা হচ্ছে হাতে-কলমে ইসলাম সংক্রান্ত বিদ্যা শিক্ষাদান ও গ্রহণ।
পরিবার খুব বেশী হ’লে দেখে দেখে শাব্দিক উচ্চারণে কুরআন পড়া শেখায়, আর কোন কোন সমাজ মসজিদে অনুরূপভাবে কুরআন শেখার ব্যবস্থা রাখে। বিষয়টা ঐচ্ছিক। সমাজস্থ সকল পরিবারের সদস্যগণ কুরআন পড়ছে কি-না তার খবর সমাজের নেতৃস্থানীয়রা নেন না। আরবী শব্দ উচ্চারণের বাইরে কুরআনের অর্থ যে মাতৃভাষায় শেখা যরূরী সে কথাও তারা মন থেকে একটু ভাবেন না। যে ইমাম বা মাওলানা ছাহেব মক্তবে পড়ান তিনিও কুরআনের অর্থ বুঝার প্রতি খুব একটা তাকীদ দেন না। ধনী হোক কিংবা দরিদ্র হোক স্কুল-কলেজ কিংবা মাদ্রাসায় সন্তানদের পড়ানোর প্রতি পরিবারগুলোর খেয়াল ও ঝোঁকের কোন অন্ত নেই। কিন্তু যে ফরযে আইন পরিমাণ ইসলামী শিক্ষা না হ’লে পরিবারের সদস্যদের ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপন সম্ভব হবে না এবং পরকালে যে তারা মহা ক্ষতি হ’তে বাঁচতে পারবে না সে বিষয়ে তাদের উদাসীনতা একেবারেই অচিন্তনীয় অভাবনীয়। কিন্তু বাস্তবে তাই হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন,قُلِ اللهَ أَعْبُدُ مُخْلِصًا لَهُ دِينِي، فَاعْبُدُوا مَا شِئْتُمْ مِنْ دُونِهِ قُلْ إِنَّ الْخَاسِرِينَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ وَأَهْلِيهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَلَا ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ، ‘বল, আমি আল্লাহর ইবাদত করি তাঁর জন্য আমার আনুগত্যকে একনিষ্ঠ করে। অতএব তোমরা তাঁকে ছেড়ে যাকে খুশী ইবাদত কর। তুমি বলে দাও নিশ্চিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যারা নিজেদের ও নিজেদের পরিবারবর্গের সর্বনাশ করে ক্বিয়ামতের দিন। মনে রেখ, সেটাই হ’ল সুস্পষ্ট সর্বনাশ’ (যুমার ৩৯/১৪-১৫)।
আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আখেরাতে শুভ ফল লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করছি? নাকি দুনিয়া লাভই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য? আমাদের এহেন আচরণের জন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন, بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا، وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى، ‘বস্ত্ততঃ তোমরা দুনিয়াবী জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাক। অথচ আখেরাত হ’ল উত্তম ও চিরস্থায়ী’ (আ‘লা ৮৭/১৬-১৭)। আমরা না পারিবারিকভাবে আমাদের উপর অর্পিত ফরযে আইন পরিমাণ দায়িত্ব কি কি তার শিক্ষা পাই, না সমাজের কোন ব্যবস্থা এ সম্পর্কে আছে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকে ইসলামী ধারায় জীবন যাপন করেন। কিন্তু কুরআন-হাদীছ অধ্যয়ন, আলোচনা, তাহারাত, ছালাত ইত্যাদি আমল পালনে তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা ধরা পড়ে। আল্লাহই অধিক জানেন।
প্রথমেই ঈমান-আক্বীদার কথা আলোচনা করা যায়। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘এমন কোন মানব শিশু নেই যে ফিৎরাতের ধর্ম বা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে না। তারপর তার মাতা-পিতা তাকে ইহুদী, খ্রিষ্টান অথবা অগ্নিপূজারী করে তোলে’।[7] এ হাদীছে সন্তানদের উপর মাতা-পিতার যে বিশাল প্রভাব রয়েছে তার প্রমাণ মেলে। পিতা-মাতা সন্তানকে যে ধর্মে চায় সে ধর্মে গড়ে তুলতে পারে। সাধারণত সবাই বাপ-দাদার ধর্মেই সন্তানদের বড় করে। হাদীছটিতে মুসলমানদের কি কোন শিক্ষা আছে? হ্যাঁ অবশ্যই আছে। হাদীছ অনুসারে মাতা-পিতা তাদের সন্তানদের যেমন ইহুদী-খ্রিষ্টান বানাতে পারে তেমনি সক্রিয় অথবা নিষ্ক্রিয় মুসলিমও বানাতে পারে। যে মুসলিম মাতা-পিতা নিজেরা সক্রিয় বা প্রাক্টিসিং মুসলিম তারা সন্তানদের প্রাক্টিসিং মুসলিম হিসাবে গড়ে তোলার চেতনা লালন করতে পারে এবং সেজন্য অবিরত চেষ্টা করতে পারে। পক্ষান্তরে ইসলামী বিধি-বিধান পালনে যারা নিষ্ক্রিয় মুসলিম তারা তাদের সন্তানদের ইসলাম সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় রাখতে একই ধরনের ভূমিকা রাখে। কারণ অধিকাংশ মুসলিম অবচেতন মনে নিজেদের বাপ-দাদা থেকে প্রাপ্ত ইসলাম মেনে চলে, তার সাথে কুরআন ও সুন্নাহর ইসলামের মিল থাকুক কিংবা না থাকুক। তাদের এ স্বভাব সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ، ‘যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার উপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপদাদারা কিছুই জ্ঞান রাখতো না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/১৭০)।
মুসলিম হিসাবে আমাদের ঈমান জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। এটা যে চর্চার বিষয় এবং এর উপর স্বতন্ত্রভাবে অনেক বই-পুস্তক লেখালেখি প্রয়োজন তা যেন আমরা ভুলে গিয়েছি। আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদে ঈমানের পর নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর রিসালাতের উপর ঈমান আনা দ্বিতীয় যরূরী বিষয়। তাঁর উপর ঈমান আনার অর্থ অন্তর থেকে বিশ্বাসের সাথে তাঁর আদর্শ অনুসরণকে জীবনের ব্রত বানিয়ে নেওয়া। কিন্তু নবী করীম (ছাঃ) সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি এবং জানতেও আমাদের তেমন কোন আগ্রহ নেই। তাঁর সম্পর্কে না জানলে, তাঁর জীবনী পাঠ না করলে, তাঁর হাদীছ না পড়লে তাঁর আদর্শ অনুসরণ তো আমাদের পক্ষে খুব একটা সম্ভব হবে না। মুসলিম নর-নারী, ছোট-বড় যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে বেরিয়ে আসবে আমাদের রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী পাঠের পরিমাণ কত কম! হাদীছের বই আমরা কি পরিমাণ পড়ি! যাঁকে চিনি না জানি না তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকার এবং তাঁকে অনুসরণের দাবী করা শুধু মুখের কথা ছাড়া আর কী হ’তে পারে?
ঈমানের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল আখেরাত। আমাদের এ জীবনই শেষ নয়, বরং মৃত্যুর সাথে সাথেই আমাদের আখেরাতের জীবন শুরু হয়ে যায়। কুরআন ও সুন্নাহ বলে দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং তা সুখ-দুঃখের মিশ্রণ। এ জীবনের আক্বীদা ও আমলের হিসাব আখেরাতে কড়ায়-গন্ডায় দিতে হবে মহান আল্লাহর দরবারে। সেখানে কেউ কাউকে সাহায্য করবে না। সবাই আত্মরক্ষার্থে ব্যতিব্যস্ত থাকবে। সেদিন যাতে সবাই মুক্তি পায় সে জন্য মুক্তির পথ দেখাতে আল্লাহ তা‘আলা পাঠিয়েছেন তাঁর রাসূল এবং নাযিল করেছেন কুরআন। রাসূলের জীবনাদর্শ আছে হাদীছে, আর কুরআন তো জীবন্ত গ্রন্থ হিসাবে আমাদের মাঝে বিদ্যমান। কুরআনই বলছে,يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لَا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئًا إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُورُ، ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর এবং ভয় কর সেই দিনকে, যেদিন পিতা তার পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্র তার পিতার কোন কাজে আসবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে এবং শয়তান যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে’ (লুকমান ৩১/৩৩)।
কিন্তু আমার মনে হয় দুনিয়াকেই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছি। চায়ের দোকান থেকে অফিস-আদালত, খেলার মাঠ থেকে বাজার-ঘাট, স্কুল-কলেজ সর্বত্রই দু’-পাঁচজন মানুষ জমায়েত হ’লে তাদের আলোচনার পুরোটাই জুড়ে থাকে দুনিয়ার কথা। কালে-ভদ্রে ধর্মের কথা, আখেরাতের কথা বলে; কিন্তু তা মনে দাগ কাটে না। মসজিদ, মাদ্রাসা ও ওয়ায-মাহফিলে আখেরাতের যৎসামান্য যে আলোচনা হয় তা দুনিয়ার আলোচনার তুলনায় নেহায়েৎ কিঞ্চিৎকর। দুনিয়াতে কে ক্ষমতাবান হ’ল, কার কী সুযোগ-সুবিধা মিলল, কার কোন বড় চাকরী মিলল, কার অর্থ-বিত্তের বাড়-বাড়ন্ত হ’ল, কে বিপদে পড়ল, কার ছেলে-মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, ওর এত হ’ল আমার কিছুই হ’ল না, ওর ছেলে-মেয়ে পড়া লেখায় কত এগিয়ে, আমারগুলো গোবরগনেশ, কার উপরি আয় ভাল, কাকে কিভাবে জব্দ করা যায়, এ জাতীয় আলোচনা করে, আর আড্ডা দিয়ে আমরা আমাদের সময় পার করি। দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধাকে আমরা বড় করে দেখি। আখেরাতের কথা ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিক ও সমষ্টিগতভাবে আমরা কমই ভাবী। দুনিয়াতে সুখে-দুখে যেভাবেই বাঁচি আমরা ক’বছর বাঁচব? অথচ আখেরাতের জীবনের কোন শেষ নেই। আখেরাতের চিরস্থায়ী সেই জীবনে নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের মহাশাস্তি থেকে রক্ষা করা এবং সবাইকে জান্নাতের লোভনীয় পুরস্কার হাছিলের জন্য ঈমান-আমলে উদ্বুদ্ধ করাই তো বুদ্ধিমান মানুষের কাজ হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা তেমন কোন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারছি না। আখেরাতে বিশ্বাস যেমন ফরযে আইন তেমনি আখেরাতের বিষয়াবলী চর্চাও ফরযে আইন।
আজ আমাদের মাঝে খুন-যখম, ব্যভিচার-ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাযানি, সূদ-ঘু্ষ, মদ, জুয়া, ভেজাল-নকল, চোরাকারবারী, যুলুম-নির্যাতন, ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ লোলুপতা, অপরের সম্পদ আত্মসাৎ, ব্যাংক থেকে কিংবা কারও থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা, মানুষের অধিকার প্রদানে কার্পণ্য, বয়স্কদের প্রতি অযত্ন দিনকে দিন যেভাবে বেড়ে চলছে তাতে আখেরাতে যে আল্লাহর সামনে আমাদের হিসাব দিতে হবে এবং এসব অন্যায়ের ক্ষমা না মিললে যে জাহান্নামে যেতে হবে সে বিশ্বাস আছে বলে আমাদের কাজে-কর্মে প্রতীয়মান হয় না। মুসলিম হয়ে এবং মুসলিম সমাজে বসবাস করে আমরা আজ ইসলামে নিষিদ্ধ অসৎকাজ কিভাবে নির্বিকারচিত্তে করে চলেছি এবং কিভাবে সৎকাজ পরিত্যাগ করে চলেছি, তা ভাববার বিষয়। ঈমানী দুর্বলতা ও নিষ্ক্রিয়তার ফলেই আমাদের আমলী দুর্বলতা ও নিষ্ক্রিয়তা তৈরি হয়েছে। মহান আল্লাহর কাছে সকাতর প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের এহেন অবস্থা পরিবর্তন করে ইসলামের সঠিক রূপে আমাদের ফিরিয়ে নেন। ঈমানী ও আমলী দুর্বলতা কাটাতে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ময়দানে নামার তাওফীক্ব দান করেন।
সমাজের দিকে তাকালে আজ দেখা যাবে ইসলামী বিধান মেনে না চলার ছড়াছড়ি। ছালাত আমাদের কাছে ঐচ্ছিক বিষয়। যার মনে চায় ছালাত আদায় করে, যার মনে চায় না আদায় করে না। যে চায় দু’এক ওয়াক্ত পড়ে, যে চায় পাঁচ ওয়াক্ত নিয়মিত আদায় করে। কিন্তু ছালাত আদায় করা লোকের থেকে না পড়া লোকের সংখ্যা দুঃখজনকভাবে বেশী। এতে মা-বাবা কিংবা পরিবারের কারও মাথাব্যথা আছে বলে দেখা যায় না। আমাদের অধিকাংশ ছালাত আদায়কারী ছালাত আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় সূরা এবং দো‘আ-কালাম যে তাজবীদের নিয়মে পড়ে না বা পড়তে পারে না তার সত্যতা যে কেউ খুঁজে দেখতে পারেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে যেভাবে ছালাত আদায় করতে দেখেছ সেভাবে ছালাত আদায় করো’।[8] হাদীছ গ্রন্থগুলোতে তাঁর শেখানো ছালাত আদায়ের পদ্ধতি অনুপুঙ্খ বর্ণিত আছে। ছাহাবীদের থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর দেখানো রীতিতে ছালাত আদায়ের পদ্ধতি জানেন এবং আমল করেন এমন মানুষও কম নন। তাঁর বর্ণিত নিয়মে ছালাত আদায় শেখা ফরযে আইন। কিন্তু মসজিদের অধিকাংশ মুছল্লীকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে তারা এমন কোন আলেম থেকে ছালাত শেখেনি কিংবা তার ছালাত আদায় সঠিক হয় কি-না তা যাচাই করেনি। শেখার কোন গরযও তারা অনুভব করে না।
প্রতি বছর রামাযান মাসে আমরা ছিয়াম পালন করি। ছিয়াম পালন ফরয। তা সত্ত্বেও বহু সংখ্যক মুসলিম যে ছিয়াম পালন করে না, সে কথাও সত্য। ছিয়াম রাখলে কি উপকার, আর না রাখলে কি ক্ষতি সে ইলম জানা ফরযে আইন। ছিয়াম ভঙ্গের কারণ, কিভাবে ছিয়াম ভাঙলে শুধু কাযা ফরয হবে এবং কখন কাযা ও কাফফারা উভয়ই ফরয হবে তা প্রত্যেক ছিয়াম পালনকারীর জানা আবশ্যক। ছিয়াম পালনে আগ্রহী হ’তে এর ফযীলত বা পুরস্কার জানাও যরূরী। কিন্তু আমরা এক্ষেত্রে সচেতনতার তেমন পরিচয় দিতে পারিনি।
যাকাত আদায়ও আমরা খুব যে হিসাব-কিতাব করে করি এবং প্রাপকদের অধিকার হিসাবে সসম্মানে তাদের হাতে তুলে দেই এমন চিত্র যাকাত আদায়কারী ভাই-বোনদের কমজনই দাবী করতে পারেন। যাকাত ফরয হয়েছে অথচ দেন না, এমন মুসলমানের সংখ্যা যাকাতদাতাদের থেকে বেশী বৈ কম নয়। ওশর বা জমির ফসলের যে যাকাত আছে তা একরকম জানিই না কিংবা ভুলে গেছি।
হজ্জ শেষে নামের সাথে আলহাজ্জ বা হাজী লেখার আগ্রহ আমাদের প্রবল। কিন্তু হজ্জের মাসআলা-মাসায়েল জেনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেখানো পদ্ধতিতে হজ্জ হ’ল কি-না, তা জানার বিষয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। অথচ হজ্জ সম্পর্কে তিনি বলে গেছেন, خُذُوا مَنَاسِكَكُمْ، ‘তোমরা আমার থেকে তোমাদের হজ্জের নিয়মাবলী শিখে নাও’।[9]
দো‘আ-দরূদ, যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি নফল ইবাদত-বন্দেগীতেও তাঁর তরীকা জানতে হবে, যাতে আমরা বিদ‘আতে লিপ্ত হয়ে না পড়ি।
পেশাগত বিদ্যার দু’টি দিক রয়েছে। প্রথম দিক ঐ পেশার সাথে জড়িত হালাল-হারাম এবং শারঈ আদেশ-নিষেধ কী আছে কিংবা না আছে তা জানা। দ্বিতীয় দিক নিজ নিজ পেশা সংক্রান্ত মৌলিক-অমৌলিক বিদ্যা অর্জন, যাতে পেশাগত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করা যায় এবং প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে তার উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটান যায়। আমাদের সমাজের মানুষকে পেশাগত বিদ্যার দ্বিতীয় দিকটি অর্জনে যথেষ্ট তৎপর দেখা যায়। কিন্তু ঐ পেশার সাথে জড়িত ইসলামী কি কি বিধি-নিষেধ আছে তা জানতে খুব কম লোককেই আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়। যেন তা কোন জানার বিষয় নয়।
হাক্কুল ইবাদ তথা মানুষের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন আমাদের জন্য আরেকটি যরূরী বিষয়। আমার নিকট কোন লোকের কি অধিকার বা পাওনা আছে তা যদি আমি জানি তাহ’লেই না আমি তা পূরণে এগিয়ে আসব। আর যদি তা কিছুই না জানি তাহ’লে তো আমার পক্ষে তাদের অধিকার যথাযথভাবে আদায় সম্ভব হবে না। কারও প্রাপ্য অধিকার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমি যদি পরিশোধ না করি তাহ’লে আমাকে অবশ্যই গুনাহগার হ’তে হবে। এজন্য কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত মানবাধিকার সম্পর্কে জানা ফরযে আইন। এসব অধিকারের মধ্যে আছে দ্বীনী অধিকার, স্নেহ-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লাভের অধিকার, আর্থিক অধিকার, আখলাক বা আচরণিক অধিকার, খেদমতজনিত অধিকার, শিক্ষণ-শিখনের অধিকার ইত্যাদি। অধিকার যারা পাবেন তাদের মধ্যে আছেন শাসক-শাসিত, মাতা-পিতা, সন্তান, স্বামী-স্ত্রী, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ধনী-গরীব, পথিক, মালিক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়-সমবয়সী, মুসলিম-অমুসলিম, পরিচিত-অপরিচিত মানুষ ইত্যাদি। তাদের অধিকার আদায়ের কথা কুরআন ও হাদীছে বার বার বলা হয়েছে।
আদব-আখলাক বা আচরণের কথা কুরআন-হাদীছে গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছে। মূলত ইসলাম মানব জীবনের সঙ্গে জড়িত সকল দিকের বিধি-বিধানের নাম। ইসলামী আদব বা শিষ্টাচার হচ্ছে প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য একজন মুসলিমকে তার দৈনন্দিন জীবনে আবশ্যিকভাবে মেনে চলা নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান, দো‘আ, যিকির-আযকার ইত্যাদির সমষ্টি।
একইভাবে ইসলামী আদব মানুষের বস্ত্তগত, মনস্তাত্বিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের সকল দিক জূড়ে আছে। প্রত্যেক হাদীছ গ্রন্থে ‘কিতাবুল আদাব’ বা ‘শিষ্টাচার’ কিংবা ‘কিতাবুল বিররি ওয়াছ-ছিলাহ’ বা ‘সদাচরণ ও সম্পর্ক তৈরি’ শিরোনামে অধ্যায় রয়েছে। ইমাম বুখারী (রহঃ) তো ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’ বা অনন্য শিষ্টাচার নামে হাদীছের একটি বড়সড় গ্রন্থই সংকলন করে গেছেন। আদবের উদাহরণ অনেক। যেমন আল্লাহ তা‘আলার সাথে বজায় রাখা আদব, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে মেনে চলা আদব, কুরআন ও সুন্নাহর সাথে আদব, মাতা-পিতার সাথে আদব, স্বামী-স্ত্রীর সাথে আদব, সন্তানের সাথে আদব, প্রতিবেশীর সাথে আদব, আত্মীয়-স্বজনের সাথে আদব, জনসাধারণের সাথে আদব, গৃহে প্রবেশ ও গৃহ থেকে বের হওয়ার আদব, পানাহারের আদব, হাঁচি ও হাই তোলার আদব, ওয়াশরুম ব্যবহারের আদব, গোসলের আদব, ঘুমানো ও জাগার আদব, পোষাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জার আদব, পথের আদব, মসজিদের আদব, মজলিসের আদব, সফরের আদব, কেনা-বেচার আদব, অফিস-আদালতের আদব, শিক্ষক-ছাত্রের আদব, উপকারীর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপনের আদব ইত্যাদি। এগুলোর প্রত্যেকটির সাথে অনেক আদব জড়িয়ে আছে। শিশুকাল থেকে যদি পরিবারের ছোটদের ইসলামী আদবে অভ্যস্ত করানো যায় তবে তারা বড় হয়ে ইসলামী আদবের সকল দিক আয়ত্বে এগিয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ।
হালাল-হারামের জ্ঞান অর্জনও ফরযে আইন। আক্বীদা ও ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলসূত্র কুরআন ও সুন্নাহ বর্ণিত আক্বীদা ও ইবাদতই কেবল হালাল। কুরআন-সুন্নাহ নিষিদ্ধ আক্বীদা ও ইবাদত হারাম। আক্বীদা ও ইবাদত ব্যতীত অন্য সকল কিছুর ক্ষেত্রে মূলসূত্র সকল বস্ত্ত, প্রাণী, কাজকর্ম, আচরণ ইত্যাদি হালাল; তবে কুরআন ও সুন্নাহ যে সকল বস্ত্ত, প্রাণী, কাজকর্ম ও আচরণ হারাম ঘোষণা করেছে সেগুলো কেবল হারাম। কাজেই মুসলিম মাত্রেই হালাল আক্বীদা ও ইবাদতের বিদ্যা শেখা ফরয। এ বিদ্যা জানা থাকলে হারাম আক্বীদা ও ইবাদতের থেকে সে বাঁচতে পারবে। অনুরূপভাবে কোন কোন বস্ত্ত, প্রাণী, কাজ-কর্ম ও আচরণ হারাম তা জানা থাকলে হালাল বস্ত্ত, প্রাণী, কাজ-কর্ম ও আচরণ নিয়ে তাকে ভাবতে হবে না। কেননা হালাল বস্ত্ত, প্রাণী, কাজ-কর্ম ও আচরণের সংখ্যা অগণিত। পক্ষান্তরে হারাম বস্ত্ত, প্রাণী, কাজ-কর্ম ও আচরণের সংখ্যা সীমিত। তার জ্ঞান আয়ত্ব করা জটিল নয়। যেমন আক্বীদা ও ইবাদতের জ্ঞান আয়ত্ব করা কঠিন নয়।
ইসলাম তো মুজাহাদা বা চেষ্টা-সাধনার নাম। চেষ্টা করেই ইসলাম অর্জন করতে হবে। চেষ্টা করেই ইসলামের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। যদিও মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ সূত্রে তাদের মুসলিম হওয়ার মূল্যকে অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে তাদের নির্বিকার উদাসীনতাকেও উপেক্ষা করা চলে না। মুসলমানদের ইসলাম থেকে এমন বিচ্যুতি তাদের কাঁদায় বলেও মনে হয় না। সত্যি বলতে কি, আমাদের ইসলাম পালনের দুর্গতি দেখে আফসোস করার মতো আজ কেউ আছে বলে চোখে পড়ে না।
[ক্রমশঃ]
মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক।
প্রবন্ধ সমুহ: মাসিক আত তাহরীক, জুলাই ২০২৫ [1]. মাদারিজুস সালেকীন ২/৪৭০; ই‘লামূল মু‘আক্কেইন ২/২৫৬।[2]. জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলীহী ১/৫৬।[3]. ফাযলুল ইল্ম ওয়াল উলামা (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী: ১ম প্রকাশ ১৪২২/২০০১ খ্রি:) পৃ: ৩০-৩১।[4]. আব্দুল বাসেত্ব ইবনু মূসা আলমাভী দিমাশকী, আল-ইকদুত তালীদ (মাকতাবাতুছ ছিক্বফাহ আদ-দ্বীনিয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৪হিঃ/ ২০০৪খ্রিঃ), পৃঃ ৭১।[5]. আবু যাকারিয়া মহীউদ্দীন আন-নববী, রাওযাতু ত্বলেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন, (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় প্রকাশ, ১৪১২হিঃ/১৯৯১ খ্রিঃ), ১০/২২৩।[6]. islamweb.net, ফৎওয়া নং ২.৪৪৯৯।[7]. বুখারী হা/১৩৫৮, ১৩৮৫।[8]. বুখারী হা/৭২৪৬।[9]. আহমাদ হা/১৪৪৫৯; মুসলিম হা/১২৯৭; নাসাঈ হা/৩০৬২; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮৮২।