প্রতিটি নতুন সকাল আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নতুন সুযোগ, একটি নতুন রহমত। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে যখন ভোরের আলো ফোটে, তখন এক অনাবিল প্রশান্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এই পবিত্র সময়ে আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে দিন শুরু করার চেয়ে উত্তম আর কী হতে পারে?
সকালের দোয়া, জিকির ও আমল শুধু আমাদের আত্মাকেই পরিশুদ্ধ করে না, বরং সারা দিনের কাজে বরকত ও সুরক্ষা নিয়ে আসে।
আসুন, জেনে নিই কীভাবে আমরা আমাদের সকালগুলোকে আরও অর্থবহ ও ফলপ্রসূ করে তুলতে পারি।
১. দিনের সেরা সূচনা: ফজরের সালাত
সকালের আমলের ভিত্তি হলো ফজরের সালাত। এটি মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সালাতগুলোর একটি, কিন্তু মুমিনদের জন্য এটি প্রশান্তি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম সেরা মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফজরের সালাত আদায় করল, সে আল্লাহর জিম্মায় চলে গেল।” (মুসলিম)
তাই ঘুম থেকে উঠে পবিত্র হয়ে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত ও দুই রাকাত ফরজ সালাত আদায়ের মাধ্যমে দিন শুরু করা অপরিহার্য।
২. ফজরের পর অবশ্য পাঠ্য দোয়া ও জিকিরসমূহ
ফজরের সালাতের পর সূর্য ওঠা পর্যন্ত বসে জিকির করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে এমনটা করতেন এবং উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন।
নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ও জিকির উল্লেখ করা হলো:
ক) আয়াতুল কুরসি (সূরা আল-বাকারাহ: ২৫৫)
এটি কুরআনের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আয়াত। যে ব্যক্তি সকালে এটি পাঠ করবে, সে সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষাকারী পাবে এবং শয়তান তার কাছে আসতে পারবে না।
আরবি:
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ۖ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
বাংলা অর্থ:
আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রা বা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবকিছু তাঁরই। কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে? তাদের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে, তিনি তা জানেন। তাঁর জ্ঞানের কোনো কিছুকেই তারা পরিবেষ্টন করতে পারে না, তবে তিনি যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া। তাঁর কুরসি আকাশ ও পৃথিবীকে পরিবেষ্টিত করে আছে এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না। আর তিনি সুউচ্চ, মহান।
খ) তিন কুল (সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস)
রাসূলুল্লাহ (সা.) সকাল-সন্ধ্যায় এই তিনটি সূরা তিনবার করে পাঠ করতে উৎসাহিত করেছেন। এটি সকল প্রকার ক্ষতি থেকে সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট। (আবু দাউদ, তিরমিজি)
উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি, লা ইলাহা ইল্লা আনতা, খালাক্কতানি ওয়া আনা আব্দুকা, ওয়া আনা ‘আলা ‘আহদিকা ওয়া ওয়া‘দিকা মাসতাতা‘তু, আ‘উযু বিকা মিন শাররি মা সানা‘তু, আবুউ লাকা বিনি‘মাতিকা ‘আলাইয়্যা, ওয়া আবুউ লাকা বিযাম্বি, ফাগফিরলি, ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুয যুনুবা ইল্লা আনতা।
বাংলা অর্থ:
হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি আপনার বান্দা। আমি আমার সাধ্যমতো আপনার সঙ্গে করা অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির ওপর দৃঢ় আছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় চাই। আমার ওপর আপনার প্রদত্ত নেয়ামতের স্বীকৃতি দিচ্ছি এবং আমার পাপের স্বীকৃতি দিচ্ছি। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয়ই আপনি ছাড়া আর কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না।
ঘ) দিনের সুরক্ষার জন্য দোয়া
আরবি:
بِسْمِ اللهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
উচ্চারণ:
বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়াদুররু মা‘আ ইসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামাই, ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম। (তিনবার পাঠ করা)
বাংলা অর্থ:
আল্লাহর নামে (দিন শুরু করছি), যার নামের সাথে পৃথিবী ও আকাশের কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (তিরমিজি)
ঙ) জ্ঞান, রিজিক ও কবুলযোগ্য আমলের জন্য দোয়া
আরবি:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا، وَرِزْقًا طَيِّبًا، وَعَمَلًا مُتَقَبَّلًا
উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ‘ইলমান নাফি‘আ, ওয়া রিযক্বান ত্বইয়্যিবা, ওয়া ‘আমালান মুতাক্বাব্বালা।
বাংলা অর্থ:
হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান, পবিত্র রিজিক এবং কবুলযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি। (ইবনে মাজাহ)
৩. অন্যান্য সকালের আমল
শুধু নির্দিষ্ট কিছু দোয়া পাঠই নয়, সকালের সময়টাকে আরও কিছু সুন্দর আমলে সাজিয়ে নেওয়া যায়।
আমাদের দিনটি কেমন যাবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে আমরা সকালটা কীভাবে শুরু করছি তার উপর। একটি শান্ত, আধ্যাত্মিক ও উৎপাদনশীল দিনের চাবিকাঠি হলো ফজরের সময়টাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো।
সকালের এই আমলগুলো আমাদের যান্ত্রিক জীবনে এক পশলা শান্তির বৃষ্টি নিয়ে আসে। এটি আমাদের মনকে স্থির করে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে মজবুত করে এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচিয়ে রেখে একটি সফল ও বরকতময় দিনের নিশ্চয়তা দেয়।
আসুন, প্রতিদিন সকালে এই সহজ আমলগুলো করার অভ্যাস গড়ে তুলি এবং আল্লাহর রহমত ও সুরক্ষায় নিজেদের জীবনকে ঢেকে নিই।