বিশ্ব বন্ধু দিবস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়াল থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় দিনটি উদযাপিত হচ্ছে নানাভাবে। বন্ধুত্বের এই চিরন্তন আবেদনকে সম্মান জানাতেই এই বিশেষ দিনের আয়োজন। কবির ভাষায়, “বন্ধু মানে আগলে রাখা ভীষণ কোনো ঝড়ে, বন্ধু মানে পাশে থাকা একটা জীবন ধরে।” এই গভীর সম্পর্ক নিয়ে ইসলাম কী বলে? ইসলামে বন্ধুত্বের স্থান কোথায়?
ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই মানব জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়—বন্ধুত্ব—নিয়ে কোরআন ও হাদিসে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ইসলামে বন্ধুত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এটিকে শুধু দুনিয়াবী সম্পর্ক হিসেবে না দেখে পরকালীন জীবনের পাথেয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
সৎ বন্ধুর গুরুত্ব: একটি রূপক
একজন ভালো বন্ধু মানুষের জীবনে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং একজন অসৎ বন্ধু কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা বোঝাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন:”সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হলো কস্তুরী বিক্রেতা ও কামারের হাপরের মতো। কস্তুরী বিক্রেতা হয় তোমাকে কিছু দান করবে, অথবা তুমি তার থেকে কিছু কিনবে, আর কিছু না হলেও তার থেকে তুমি সুগন্ধি পাবে। অন্যদিকে, কামারের হাপর হয় তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে, নতুবা তুমি তার থেকে দুর্গন্ধ পাবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৫৩৪)
এই হাদিসটি স্পষ্ট করে দেয় যে, ভালো বন্ধুর সংস্পর্শ একজন মানুষকে ভালো হতে সাহায্য করে, আর মন্দ বন্ধুর সঙ্গ তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
কোরআনের আলোকে বন্ধু নির্বাচন
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বন্ধু নির্বাচনের বিষয়ে মুমিনদের সতর্ক করেছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
১. মুমিনরা পরস্পর বন্ধু: আল্লাহ বলেন, “আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কাজের আদেশ দেয়, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে।” (সুরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৭১)।
এই আয়াত অনুযায়ী, ঈমানদারদের বন্ধুত্বের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস ও সৎকর্ম।
২. ভুল বন্ধু চেনার আফসোস: পরকালে মানুষ তার ভুল বন্ধু নির্বাচনের জন্য আফসোস করবে। আল্লাহ তাআলা সেই চিত্র তুলে ধরে বলেন, “হায়, দুর্ভোগ আমার! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! অবশ্যই সে তো আমাকে উপদেশবাণী (কোরআন) থেকে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে তা আসার পর।” (সুরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২৮-২৯)।
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, বন্ধুত্বের প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী।
৩. প্রকৃত বন্ধুত্ব টিকে থাকবে পরকালেও: দুনিয়ার সব স্বার্থের বন্ধুত্ব কিয়ামতের দিন শেষ হয়ে যাবে। কেবল আল্লাহকে ভালোবেসে যে বন্ধুত্ব, সেটাই টিকে থাকবে। আল্লাহ বলেন, “সেদিন (কিয়ামতের দিন) মুত্তাকিরা (আল্লাহভীরুরা) ছাড়া সব বন্ধু একে অপরের শত্রু হয়ে যাবে।” (সুরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৬৭)।
কেমন হবে একজন ভালো বন্ধু?
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন ভালো বন্ধুর কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক:
আল্লাহভীরু (মুত্তাকি): যে বন্ধু আপনাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং ভালো কাজে উৎসাহ দেয়, সেই প্রকৃত বন্ধু।
সৎ ও বিশ্বস্ত: তিনি আপনার আমানত রক্ষা করবেন এবং আপনার অনুপস্থিতিতেও আপনার সম্মান রক্ষা করবেন।
জ্ঞানী ও বিচক্ষণ: তিনি আপনাকে সঠিক পরামর্শ দেবেন এবং ভুল পথে চালিত হতে দেবেন না।
কল্যাণকামী: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “একজন মুমিন আরেকজন মুমিনের জন্য আয়নার মতো।” (সুনানে আবু দাউদ)।
আয়না যেমন কোনো ময়লা থাকলে তা দেখিয়ে দেয়, তেমনি একজন প্রকৃত বন্ধু আপনার ভুলগুলো ভালোবাসার সাথে শুধরে দেবে।
বন্ধুত্ব একটি পবিত্র সম্পর্ক। বিশ্ব বন্ধু দিবসের এই ক্ষণে আমাদের উচিত নিজেদের বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোকে ইসলামের আলোকে মূল্যায়ন করা। আমাদের বন্ধু কি আমাদের জান্নাতের পথে সাহায্য করছে, নাকি জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? একজন ভালো বন্ধু আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিরাট নিয়ামত। আসুন, এমন বন্ধু নির্বাচন করি, যাদের বন্ধুত্ব শুধু এই পৃথিবীতে নয়, বরং পরকালেও আমাদের জন্য ছায়া হয়ে থাকবে। কারণ ইসলামে বন্ধুত্ব কেবল একদিনের উদযাপন নয়, বরং সারা জীবনের পথচলার এক অমূল্য পাথেয়।