মোঃ আব্দুল আউয়াল।
বাংলার লোকসাহিত্য মানে শুধু গল্প বলার বা গান গাওয়ার সংস্কৃতি নয়—এটি সমষ্টিগত স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও পরিচয়ের দীর্ঘ পথযাত্রা। হাজার বছরের সমাজগঠনের যে গল্প, নদীভিত্তিক সভ্যতার যে দ্বন্দ্ব–সংগ্রাম, কৃষিজীবনের যে হাসি–কান্না—সবকিছুই লোকসাহিত্যের মধ্য দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আজকের আমাদের সামনে। বাংলা জাতির শিকড়, ভাষা, কল্পনা, শিল্পবোধ—সবকিছুর বোধগম্যতার জন্য তাই লোকসাহিত্য অপরিহার্য।
বিশেষত লোকগান—যার মধ্য দিয়ে বাঙালি তার আবেগ, দর্শন ও অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে শক্তিশালীভাবে প্রকাশ করেছে। বাংলার লোকগান শুধু শিল্প নয়, এটি সমাজের প্রতিচ্ছবি, মানুষের বিশ্বাসের দলিল এবং সময়ের নথি। এই প্রবন্ধে লোকসাহিত্যের বিস্তৃত আলোচনার পাশাপাশি বাংলার বিভিন্ন লোকগানের ধারা, রূপ, বিষয়বস্তু, ইতিহাস ও সামাজিক তাৎপর্য তুলে ধরা হবে।
লোকসাহিত্যের ধারণা ও বৈশিষ্ট্য-
লোকসাহিত্য হলো সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত সাহিত্য। এটি লিখিত হয় না, বরং স্মৃতি, আবেগ ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে চলমান থাকে।
লোকসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য—লোকসাহিত্য হলো সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত সাহিত্য। এটি লিখিত হয় না, বরং স্মৃতি, আবেগ ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে চলমান থাকে।
লোকসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য—
- মৌখিকতা: প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া।
- সমষ্টিগত রচনা: কোনও একক লেখক নেই; বহু মানুষের অবদান।
- আঞ্চলিকতা: অঞ্চলভেদে ভাষা, সুর, ধ্বনি ও কাহিনির ভিন্নতা।
- প্রকৃতিনির্ভরতা: নদী, মাঠ, বন, কৃষি, ঋতুকে কেন্দ্র করে গল্প-গান।
- অলৌকিকতা ও প্রতীক: দেবদেবী, অতিপ্রাকৃত শক্তি, রূপক ও মিথ।
লোকসাহিত্য মূলত ছয় ভাগে বিভক্ত: লোককথা, লোকগান, লোকনৃত্য, রীতিনীতি ও আচার, প্রবচন ও ধাঁধা, এবং মঙ্গলকাব্য। এর ভেতর লোকগান সবচেয়ে প্রাণবন্ত, সবচেয়ে বিস্তৃত এবং সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়।
বাংলার লোকগান: প্রাণের স্পন্দন
বাংলার লোকগানকে বলা হয় বাঙালির অন্তরঙ্গ ইতিহাস। নদী, নৌকা, প্রেম, বিচ্ছেদ, কৃষি, ধর্ম, সংগ্রাম, আধ্যাত্মিকতা—যে আবেগ মানুষের জীবনকে ঘিরে থাকে, তার সবটুকুই লোকগানে প্রতিফলিত হয়।
বাংলার লোকগানের বৈশিষ্ট্য—
- সুরের সরলতা
- কথ্যভাষার ব্যবহার
- প্রকৃতি ও জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
- আবেগের তীব্রতা
- দার্শনিক মূর্ছনা
- অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন
এখন ধারাবাহিকভাবে বাংলার প্রধান লোকগানের ধারা আলোচনা করা হলো।
বাউল গান: মানুষের ধর্ম, দেহতত্ত্ব আর অনন্তের সন্ধান
বাউল গানকে বলা হয় বাংলার আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ রূপ। লালন শাহ, দুখু শাহ, রাম বসু, পান্নু শাহসহ অসংখ্য বাউল বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বিশ্বে পৌঁছে দিয়েছেন।
লালনের বিখ্যাত গানগুলো—
- “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”
- “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি”
- “শূন্যের উপর শূন্য ঘর, সেই ঘরে নাই দরজা”
- “সবার উপরে মানুষ সত্য”
বাউল গান দেহকে ‘মাইক্রো কসম’ হিসেবে দেখে। মানুষের শরীরেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য। প্রেমের মাধ্যমে, মানবিকতার মাধ্যমে, মানুষের ভেতরের মানুষকে চিনে নেওয়ার মাধ্যমে মুক্তির পথ দেখায় এই গান।
বাউলের আরেক ধারা মুর্শিদি-মারফতি গান—যেখানে আল্লাহ–নবী–পীর–মুর্শিদের সন্ধান, স্ব-অনুসন্ধান এবং মানবপ্রেম ফুঁটে ওঠে। যেমন—
- “পীর মুর্শিদের দরবারে প্রণাম জানাই”
- “আল্লাহ মেঘ দে পানি দে, ছায়া দে রে তুই”
ভাটিয়ালি: নদীর বুকের হাহাকার
বাংলার নদীমাতৃক সভ্যতা ভাটিয়ালি ছাড়া অসম্পূর্ণ। নৌকার মাঝিদের গান—যার সুরে থাকে নদীর স্রোত, হাহাকার, অপেক্ষা, প্রেম, বেদনা।
ভাটিয়ালির বিখ্যাত গান—
- “নাইয়্যার লগে দুলাল গো আমার, দৌলতদিয়া ঘাটে নাও বাঁধো”
- “ওরে নাও বড় বৈঠা আমার, মাঝি দেরি কইরো না”
- “ও ভাটিয়ালি গীত গাওয়া যায় না”— দীর্ঘ টানে সুরারোপ।
নদী শুধু জীবিকার উৎস নয়, এটি প্রেম, সংগ্রাম আর অস্তিত্বের অংশ। ভাটিয়ালির স্বর তাই স্বভাবতই দীর্ঘ, টানযুক্ত এবং বেদনার্ত।
ভাওয়াইয়া: উত্তরের বেহারাদের বেদনা
রংপুর, কুঁড়িগ্রাম ও আসামের কামরূপ-কোচবিহার অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গাওয়া হয়। এই গান সাধারণত গরুর গাড়ির বেহারা, শ্রমজীবী মানুষের বেদনা, প্রেম–বিচ্ছেদ, দাম্পত্যের টানাপোড়েন নিয়ে।
বিখ্যাত ভাওয়াইয়া—
- “ও কি গাড়িয়াল ভাই, চিলমেকির বাঁকে রে”
- “যাইও না গাড়িয়াল ভাই, নিয়ে যাও আমায়”
- “বাঁশরির সুরে গান গাইবো, তুমি যাও কোথায় রে”
ভাওয়াইয়া গানে শ্রমজীবী মানুষের অন্তর্গত বেদনা, দূরত্ব, অস্থিরতা খুব স্পষ্ট।
জারি, সারি ও গাজীর গান: শোক, বীরত্ব ও বিশ্বাসের ধারা
জারি গান
ইমাম হুসাইনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শোকগাথা ধারা। তবলা, ঢোল, করতালসহ বাদ্যযন্ত্রে সুরলগ্ন। যেমন—
- “হায় রে কারবালা, হায় রে শোকে”
- “আহারে তাজিয়া, দ্যাখ আইসা কাপ”
সারি গান
নৌ-দৌড় ও দলগত শক্তির গান।
- “নাও ছাড় ঠেলা মারো, মাঝির বুকে জোশ”
- “হাল ধরো মাঝিরে ভাই, জোয়ার এসেছে”
গাজীর গান
মুসলিম সাধক গাজী পীরকে কেন্দ্র করে। ধর্মীয় হলেও এর মূল বিষয় সমাজের নিরাপত্তা, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস।
কীর্তন, রাধা–কৃষ্ণলীলা ও ধামাইল
এই গানে দেখা যায় প্রেম, ভক্তি ও সামাজিক উৎসবের রূপ।
- “হরি দিন তো গইল সাঁঝ হইল”
- “এ কি লীলা বৈঠাইলা শ্যাম”
ধামাইল মূলত সিলেট অঞ্চলের নৃত্যধর্মী গান—বিয়ে ও উৎসবে নারী-গানের প্রধান অংশ।
লোককথা: গ্রামবাংলার গল্পভুবন
বাংলার লোককথায় পাওয়া যায়—
- প্রাণীকথা: শেয়াল–কাঠবিড়ালি–বাঘের গল্প
- হাস্যরস: গোপাল ভাঁড়
- নীতিকথা: বাবার উপদেশ, গ্রামের অভিজ্ঞতা
- অলৌকিক আখ্যান: বেহুলা-লখিন্দর, মাণিক-পীর
- বীরগাথা: বাংলার গ্রামীণ যোদ্ধাদের গল্প
‘ঠাকুরমার ঝুলি’ শুধু শিশুতোষ গল্প নয়; এটি সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও কল্পনার শক্ত উইন্ডো।
মঙ্গলকাব্য: লোকবিশ্বাস ও সমাজবাস্তবতার দলিল
মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল—এসব কাব্য মূলত দেব–দেবীর আখ্যান হলেও ভিত্তিতে রয়েছে কৃষিজীবনের সংগ্রাম, সামাজিক বিভাজন, ভূমির মালিক–চাষীর দ্বন্দ্ব।
মনসামঙ্গলের বিখ্যাত লাইন—
“গাঁয়ের মানুষ, গাছের ডাল, জল আর জীবনের গল্প”—
এটি কৃষিভিত্তিক সমাজের জীবনযাত্রার প্রতীক।
লোকসাহিত্যে জীবনযাত্রার প্রতিফলন
১. কৃষিজীবন
ধান, মাছ, মৌসুম, বৃষ্টি—সবকিছুই গানের বিষয়। যেমন—
- “আষাঢ়ে গরজে মেঘ, সোনার ফসল হবে”
- “ধানের শিষের সঙ্গে বাঁধা আমার মন”
২. নদী ও নৌ-সংস্কৃতি
ভাটিয়ালি, সারি গান, ঢেউয়ের চিত্র; নদী বাঙালির জীবন–মৃত্যুর সঙ্গী।
৩. প্রেম ও বিচ্ছেদ
বাংলার প্রায় সব লোকগানের মূল বিষয় প্রেম–বিচ্ছেদ—
- “ও মোর মায়ের চোখের মণি, কই গেলে তুমি”
- “যাই যাই বলে তুমি আর যাইলে না”
৪. আধ্যাত্মিকতা
বাউল, মুর্শিদি, মারফতি—সব গানের কেন্দ্রে মানুষের ভেতরের মানুষ।
লোকসাহিত্যের বর্তমান সংকট
- নগরায়ন ও প্রযুক্তির কারণে মৌখিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে
- লোকশিল্পীদের দারিদ্র্য
- লোকগানের বাণিজ্যিক বিকৃতি
- তরুণ প্রজন্মের দূরে সরে যাওয়া
- আর্কাইভ ও গবেষণা স্বল্পতা
একসময় যেসব গান মাঠ–ঘাট–নৌকা–বাড়ির উঠোনে প্রতিদিন শোনা যেত, তা আজ শুধুই উৎসব বা স্টেজে সীমাবদ্ধ।
লোকসাহিত্যের ভবিষ্যৎ: সংরক্ষণই প্রধান চ্যালেঞ্জ
বাংলার লোকসাহিত্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন—
- সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
- ডিজিটাল আর্কাইভ
- লোকশিল্পীদের আর্থিক সহায়তা
- গবেষণা প্রতিষ্ঠান
- বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক পাঠ
লোকগান শুধু সংগীত নয়; এটি ইতিহাস–দর্শন–সমাজতত্ত্ব—সবকিছুর সমাবেশ।
উপসংহার
বাংলার লোকসাহিত্য বাঙালির আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু। লোকগান, লোককথা, মঙ্গলকাব্য, আচার, রীতিনীতি—সব মিলিয়ে এটাই আমাদের সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড। বাউলের মানবধর্ম, ভাটিয়ালির নদী-হাহাকার, ভাওয়াইয়ার অস্থিরতা, কীর্তনের ভক্তি, জারি–সারির আবেগ—সবই মিলিয়ে বাঙালির জীবনের পূর্ণচিত্র।
বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মানবিকতার যে শেকড়—লোকসাহিত্য সেই শেকড়কে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাই লোকসাহিত্য সংরক্ষণ শুধু সাংস্কৃতিক দায় নয়; এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার কাজ। এবং এই ঐতিহ্যকে আগামীর প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়া আমাদের অন্যতম সামাজিক কর্তব্য।
লেখক-অধ্যক্ষ, ছাতিয়ানতলা কলেজ,বাঘারপাড়া,যশোর।