মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন- আর আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। নৈতিক, মানবিক ও আধ্যাত্মিক তথা একজন মহামানব হিসেবে বিবেচ্য হওয়ার সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্য তাঁর মাঝে যুগপৎভাবে বিদ্যমান। তিনি ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, উচু-নীচু, সাদা-কালো, আরব-আজমী নির্বিশেষে মানবতার কল্যাণের জন্য ব্রতী ছিলেন। মানবতাবাদ বা জীবনকে পূর্ণরূপে বিকশিত করার জন্য তাঁর ছিল চুড়ান্ত প্রচেষ্টা ও সাধনা।
বিশ্বনবীর কথা ও সমগ্র কর্মজীবনে মানবতাবাদের চরম বিকাশ লাভ করে। তিনি এ মানবতাবাদের শুধু প্রচার করেই ক্ষান্ত হননি বরং নিজের জীবনেও তার রূপায়নের চেষ্টা করেছেন এবং মদীনাভিত্তিক একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে দেখিয়ে গেছেন মানবতাবাদকে কিভাবে রূপায়ন করতে হয়। মানবতার প্রতি তাঁর মনে কত শ্রদ্ধা ও দরদ ছিল নিম্নোক্ত উক্তিতে তা সহজেই ফুটে উঠে- ‘সেই ব্যক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ যার কাছ থেকে মানবতা নানাবিধ কল্যাণ লাভ করে’।
মানবতা একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। আর ইংরেজিতে Humanity, Sympathy, Kindness, Understanding, Benevolence, Generosity, Helpfullness ও Charitableness ইত্যাদি।
• Oxford English Dictionary বলা হয়েছে- Human beings (thought of) as a group বা সাধারণ মনুষ্যজাতি কিংবা এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে Human nature বা The quality of being human A অর্থ্যাৎ মনুষ্যচিত গুনাবলী বা মনুষ্য প্রকৃতি ।
মানবতাবাদের সংজ্ঞায় বলা যায়-Humanism is a system of beliefs that concentrates on common human needs and seeks ways of solving human problems based on reason than on faith in God. অর্থাৎ মানবতাবাদ হচ্ছে- এমন কিছু প্রচলিত ধারণা বা বিশ্বাসের উদ্ভাবন, যা মানবসমাজের দৈনন্দিন ও নিত্যনৈমত্তিক প্রয়োজনের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে এবং মানুষের সমম্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বিধাতায় বিশ্বাসের চেয়ে অধিক যুক্তিনির্ভর মুক্তপথের সন্ধানে প্রয়াসী হয়।
• Encyclopedia Britanica তে আছে Av‡Q- An attitude of mind attaching prime importance to human beings and human values, often regarded as the central theme of renaissance civilation. অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গীর এমন একটি লক্ষ্যস্থল যেখানে ‘মানুষ’ই হচ্ছে সর্বাধিক প্রাধান্য পায়। মানুষ ও তার নিজস্ব মূল্যবোধের এই কেন্দ্রিকরণ অনেক সময় রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের সারকথা বলে বিবেচিত হয়।
মানবতাবাদ সম্পর্কে বিশ্বনবীর নীতি ও দর্শনই সর্বশেষ্ঠ। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে মানবজাতি ছিল চরম উপেক্ষিত ও অবহেলিত। তিনি তাদেরকে মানবতার ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত করে সৃশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেছেন। মানুষের মাঝে সমতা বিধান এবং সম্পদ, ঐশ্বর্য ও সুযোগ সুবিধার সুষম বণ্টনের জন্য তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। যা জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতির কল্যাণের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর জীবদ্ধশায় মানবতাবাদের পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটিয়ে সমাজে সুখ, শান্তি, ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপস্থাপিত হলো:
আরববাসীদেও নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, মারামারি, ঝগড়া, কোন্দল, কুসংস্কার ও মূর্তিপূজা মুহাম্মদ (সা.) কে বিচলিত করেছিল। তিনি এর প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে কিশোর বয়সেই একটি শান্তি সংঘ গড়ে তুলেন। তাঁর কনিষ্ঠ চাচা যুবাইর ও কতিপয় উৎসাহী যুবক এ সংঘের অন্যতম সদস্য ছিলেন। সংঘের সদস্যগণ সমবেতভাবে নিন্মোক্ত শপথ গ্রহণ করেন-
১. আমরা দেশের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করব;
২. অত্যাচারীর হাত থেকে নিরীহ মজলুমদেরকে রক্ষা করব এবং জুলুম ও জালিমকে দমন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব;
৩. দরিদ্র ও অসহায় লোকদের সহায়তায় সর্বদা সচেষ্ট থাকব;
৪. বিদেশী লোকদের জান-মাল ও মান-সম্ভ্রম রক্ষা করতে চেষ্টা করব।
তৎকালীন সামাজিক পরিবেশে এ ধরনের উন্নত প্রচেষ্টা পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। গ, M. Watt বলেন- ÔIts aim was to uphold principle of justice against the malepractice of the stronger and richer tribes.
মহানবীর (সা.) চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানবিক আচরণ। তাঁর আহবানকে বড়রা বিবেচনা করেছে বুদ্ধি বিবেক দিয়ে আর ছোটরা বিবেচনা করেছে তাঁর মানবিক আচরণ দিয়ে। তিনি ছিলেন শিশু-কিশোরদের প্রিয়তম বন্ধু ও খেলার সাথী। তাদের প্রতি তাঁর ভালবাসার অন্ত ছিল না। তাদেরকে ¯েœহভরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন এবং গল্প ও কবিতা শোনাতেন। তাদের নিয়ে খেলতেন, দৌঁড় প্রতিযোগিতা দিতেন আর আনন্দ করতেন। শিশু-কিশোররা দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দৌঁড়ে এসে নবীজীর দেহ মোবারকে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আর তিনি তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কার দিতেন। তিনি শিশু-কিশোরদের ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ হযরত হাসান ও হোসাইন (রা.) কে নিয়ে অবসর সময় কাটাতেন। তাদের সাথে ঘোড়া ঘোড়া খেলতেন। নিজে ঘোড়া সেজে নাতিদের পিঠে নিয়ে আনন্দ করতেন। তিনি ছিলেন শিশু-কিশোরদের প্রতি পরম ¯েœহ পরায়ণ ও করুণাময়। তিনি তাদেরকে প্রাণপন ভালবাসতেন। শিশুসুলভ ও দরদমাখা মন নিয়ে কোলে তুলে নিতেন এবং আদর করে গালে চুমো দিতেন। ফলে শিশুরাও তাকে সীমাহীন শ্রদ্ধা করত। যা অনেকগুলো হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয়।শিশুদের অধিকার রক্ষায় বিশ্বব্যাপি আজ উচ্চারিত হচ্ছে ‘শিশুর জন্য হ্যাঁ বলুন’ শ্লোগানটি। অথচ আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বে তিনি শিশুদের প্রতি
অন্ধকার যুগে যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ পরাজিত পক্ষের মেয়েদের ধরে নিয়ে বিয়ে করত। এ অপমান থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য তারা কন্যাকে ঘৃণা করত এবং জীবন্ত কবর দিত। সেই জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে ইসলাম এনে দিল পিত্রালয়ে, ধন্য করল তার জন্ম ও জীবন। পবিত্র কুরআন তাকে পুষ্পমাল্যে নন্দিত করল। মর্মস্পর্শী আয়াত নাযিল হলো তার প্রতিপালন, সম্পদ উত্তরাধিকারের ঘোষণা নিয়ে। পিতা ও আত্মীয়-স্বজনের সম্পত্তিতে কন্যাদের স্বত্ত¡ প্রতিষ্ঠিত হলো। অনাদৃতা ও অবহেলিত কন্যা ফিরে পেল তার অধিকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলো। মহানবী (সা.) তাদেরকে শিক্ষার প্রতিও গুরুত্বারোপ করলেন। মোটকথা কন্যা সন্তান পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিগণিত হলো। তিনি ঘোষণা দিলেন- ‘মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত’। তিনি আরো বললেন- ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তানকে প্রতিপালন করল, আদব শিখাল, বিবাহ দিল এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করল, সে জান্নাতের অধিকারী’। তাই তাকে নারী মুক্তির পথিকৃৎরূপে উল্লেখ করে পিয়েরে ক্রাবাইট দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষণা করেন- ‘Muhammad was the greatest champion of women’s rights the world has ever seen.’
একদা মহানবী (সা.) ঈদের নামাজ শেষে সবার সাথে কোলাকুলি করে তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। মুসল্লিগণ বিদায় নেয়ার সময় দেখতে পেলেন একটি ছোট্ট ছেলে ঈদগাহে বসে বসে কাঁদছে। মহানবী (সা.) ছেলেটির কাছে গেলেন এবং কোলে তুলে নিয়ে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ছেলেটি বলল, আপনার কাছে আমার মনের দুঃখ বলে লাভ নেই। বরং আমি ঐ মহানবীর (সা.) জন্য অপেক্ষা করি, যিনি একজন ইয়াতিমের দুঃখ বুঝবেন। তাঁর নিকট আমার মনের কথা বলে লাভ হবে। মহানবী (সা.) দাঁড়ানো থেকে বসে গিয়ে ছেলেটিকে কোলে বসিয়ে বললেন, তুমি যার সাথে দেখা করতে এসেছ, আমি সেই ইয়াতিম মুহাম্মদ (সা.)। সুতরাং তুমি আমার কাছে তোমার মনের কথা খুলে বল। ছেলেটি হাউ মাউ করে কেঁদে বলল, আমার পিতা মারা গিয়েছেন। মা অভাবের তাড়নায় অন্য একটি লোককে বিবাহ করেছে। আমার মা আমাকে আদর করুক, ঐ লোকটি তা মোটেই চায় না। বরং আমাকে ও আমার মাকে প্রহার করে। তাই আমার মা বলেছেন, বাবা! তোমার দুঃখ একমাত্র মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া আর কেউ বুঝবেন না। তাই আজ আমি সেই মহানবীর (সা.) সাথে সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছি। মহানবী (সা.) ছেলেটির সব কথা শুনে আদর করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হযরত আয়েশা (রা.) কে বললেন, দেখ আয়েশা! আজকের এ ঈদের দিনে মহান আল্লাহ আমাদের জন্য একটি ছেলে উপহার দিয়েছেন। এভাবে তিনি অসংখ্য ইয়াতিমের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন।
ইসলামপূর্ব যুগের সামরিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের হত্যা কিংবা দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হত। অথচ মহানবী (সা.) তাদের প্রতি দয়া ও সহানুভূতির এক অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন। তিনি বলেছেন- ‘বন্দীদের সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার কর’। বদর যুদ্ধে বিজয়ী সাহাবীগণ পায়ে হেঁটে গিয়েছেন আর পরাজিত বন্দীদেরকে উটে আরোহন করিয়ে নিয়ে গেছেন। নিজেরা শুকনো খেজুর খেয়ে বন্দীদেরকে রুটি খেতে দিয়েছেন। অনুরূপভাবে মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের চিরশত্রæ কুরাইশদের প্রতি যে দয়া, সৌজন্যতা ও সহানুভূতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন এবং তাদেরকে যেভাবে মুক্তি দেয়া হয়েছে ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মক্কা বিজয়ের সাথে সাথে তিনি ঘোষণা করেন- ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই, তোমরা সকলেই মুক্ত’। এ সাধারণ ক্ষমাকে লক্ষ্য করে ঐতিহাসিক গীবন বলেছেন- ‘ÔIn the long history of the world there is no instance of magnanimity and foregiveness which can approach those of Muhammad when all his enemies lay at his feet and he forgave them one and all.
সন্ত্রাস যে নামেই আখ্যায়িত হোক না কেন তা সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ইবলিসের উর্বর মস্তিস্ক থেকেই এর আবিষ্কার। যথাসময়ে ও দক্ষ হাতে এর মূলোৎপাটন করা না গেলে গোটা সমাজে পচন ধরে। সুষ্ঠু ও শান্তিময় সমাজব্যবস্থার অকালমৃত্যু ঘটে। তাই সকল মানুষ যেন সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারে, বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে এবং গুটিকয়েক দুর্বৃত্তের দুরাচারের কারণে শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবন যাতে দুর্বিসহ হয়ে না পড়ে সেজন্য মহানবী (সা.) সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। এ জন্য তিনি বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যাপক তৎপর ছিলেন। সমাজের সকল অন্যায়, অত্যাচার, অনাচারসহ সন্ত্রাসকে কঠোরভাবে প্রতিহত করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘যদি আসমান ও যমীনের সকল অধিবাসী একজন মুসলমানকে অবৈধভাবে হত্যা করার জন্য একমত পোষণ করে, তবে আল্লাহ তাদের সবাইকে অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।
মহানবী (সা.) এর আবির্ভাবের পূর্ব থেকেই আরবসহ সমগ্র বিশ্বে দাসপ্রথা বিদ্যমান ছিল। বিশেষত পরাজিত গোত্র বা জাতির যুদ্ধবন্ধীদেরকে দাসে পরিণত করা হত। তাদেরকে পশুর মত বাজারে কেনা-বেচা করা হত। তাদের সাথে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট আচরণ করা হত। মনিবের হাতে অকথ্য নির্যাতনই ছিল যেন তাদের প্রাপ্য। এভাবে নির্যাতিত হয়েছেন হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার, হযরত বিলাল, তাপসী রাবেয়া বসরী এমনকি শেখ সাদীও। বিচারপতি আমীর আলী দাসদের প্রতি অকথ্য নির্যাতনের করুণচিত্রের তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘ÔSerfs or salves, for them there was no hope or gleam of sunshine on this side of the grave’ এরিস্টটলের মত বিশ্বনন্দিত দার্শনিকও ঘোষণা করেছিলেন- দাসপ্রথা একটি স্বাভাবিক অবস্থা। প্লেটোও দাসপ্রথার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেননি বরং সভ্যতার অগ্রগতিতে এ প্রথার সমর্থনই করেছেন। এহেন প্রেক্ষাপটে মহানবী (সা.) মানবতাকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছেন। তিনি এ প্রথাকে উচ্ছেদকল্পে ঘোষণা করেন-‘তোমাদের ভাইয়েরাই তো তোমাদের দাস। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন।
তাই যার অধীনে তার একটি ভাই রয়েছে, তার উচিত সে যা খাবে তাকেও তা খেতে দেবে এবং সে যা পরিধান করবে তাকেও তা পরিধান করতে দেবে’। দাসদেরকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করতে গিয়ে বলেন- যোগ্যতার বলে যদি কোন হাবশী গোলামও নেতৃত্ব পায়, তবে তাকে মান্য করবে। তিনি হযরত বিলালকে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন, হযরত উসামাকে সেনাপতি নিয়োগ, হযরত যায়েদ বিন হারেসাকে নিজ সন্তানের মত মানুষ করেন। এভাবে তিনি বিশ্বশান্তি কামনায় মানুষকে তার মর্যাদাবোধে উজ্জীবিত ও প্রতিষ্ঠিত করে সুদূরপ্রসারী শান্তিময় সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন।
প্রাক ইসলামী যুগে আরবদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও জাতির মধ্যে কোন ঐক্যের চেতনা ছিল না। গোত্রে-গোত্রে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, পিতা-পুত্রে হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-ফাসাদ ও খুন-খারাবি সবসময় লেগে থাকত। তারা তাদের স্বীয় ¯্রষ্টার কথা, আল্লাহর খিলাফাতের কথা এমনকি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা ভুলে গিয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেন- ‘হে লোক সকল! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন গোত্রে ও পরিবারে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার’। মহানবী (সা.) তাদেরকে আল্লাহর এ বাণী শুনিয়ে দিয়ে সেই ঘুনেধরা সমাজকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করে সকল সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে মানবতাভিত্তিক এমন এক নতুন জাতি ও সমাজ গঠন করেছিলেন, যেখানে মানগত আভিজাত্যের কোন স্থান ছিল না। ছিল না কোন ধনী-দরিদ্র ও ছোট-বড়র পার্থক্য। অধ্যাপক পি.কে হিট্টির মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন- ‘ÔWithin a brief of normal life Muhammad called faith out of uncompromising material nation never united before in a country that was hitherto but a geographical expressio
বিশ্বের সকল মানুষ একই আদমের সন্তান। সুতরাং প্রত্যেকেই একে অপরের ভাই। তাই একজন আরেকজনের উপর প্রভুত্ব করবে, অত্যাচারের যাতাকলে নিষ্পেষণ করবে এটা হতেই পারে না। আর মহানবীর (সা.) পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্যই হলো সমাজ থেকে অত্যাচার অনাচার দূরীভূত করে প্রকৃত বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ঘোষণা করলেন- ‘সকল মুসলিম একে অপরের ভাই’। বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন- ‘তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম মাটির তৈরি। একমাত্র তাকওয়া ছাড়া অনারবদের উপর আরবদের এবং আরবদের উপর অনারবদের কোনও প্রাধান্য নেই’। মহানবীর (সা.) এ আদর্শ গোত্রভিত্তিক সমাজের কৃত্রিম আভিজাত্যবোধের মূলে কুঠারাঘাত হেনে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত উদারনৈতিক সমাজের উদ্ভব ঘটে। ঐতিহাসিক খোদা বক্স বলেন- ‘ÔThe immediate result of the prophet’s teaching was the dissolution of the tribal system and the foundation of the brotherhood of Islam.’
পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্বব্যাপি মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় মহানবীর (সা.) দর্শন, চিন্তা-চেতনা ও তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ছিল অুুলনীয়। এ ব্যাপারে তাঁর সুবিস্তৃত কর্মকান্ডে অভিভূত হয়ে বিশ্ববিখ্যাত মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ’ ঘোষণা করেন- ‘আমি মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেছি। আমার অভিমত, এ চমৎকার মানুষটি দাজ্জাল তো ছিলেনই না, বরং তাকে মানবজাতির ত্রাণকর্তারূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, মুহাম্মদের ন্যায় একজন ব্যক্তি যদি সমস্ত পৃথিবীর একনায়কত্ব গ্রহণ করেন তাহলে তিনি বর্তমান বিশ্বের সমস্যাদি এমনভাবে সমাধান করতে সক্ষম হবেন, যা বিশ্বের জন্য বহন করে আনবে অপরিহার্য এবং বহু প্রতীক্ষিত সুখ ও শান্তি’। বর্তমানেও যদি মহানবীর (সা.) এ সুমহান শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে একটি অর্থবহ ও কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় তাহলে রচিত হবে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির অবারিত ফল্গুধারা।