শাহাদত হোসেন কাবিল
যশোরের চিনি কেবল স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতো তা নয়। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রফতানিও হতো। শীতকালের শেষভাগে বরিশালের ব্যবসায়ীরা বড় বড় নৌকা ভর্তি করে চাল এনে বিক্রি করে চিনি কিনে নিয়ে যেতো। চিনির সাথে তারা প্রচুর গুড়ও নিয়ে যেতো।
তৎকালীন যশোরের কোটচাঁদপুর ও কেশবপুরে ছিল প্রধান চিনি মোকাম। এ ছাড়া চৌগাছা ও ত্রিমোহিনীতে চিনির ব্যবসায় চলতো। অন্যান্য স্থানের মধ্যে রাজারহাট ,খাজুরা, মণিরামপুর, ঝিকরগাছা, বসুন্দিয়া, নওয়াপাড়া প্রভৃতি স্থানও চিনি উৎপাদন ও ব্যবসায়ের জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল। ঝিকরগাছা, যাদবপুর, কালীগঞ্জ, নওয়াপাড়া প্রভৃতি স্থানে চিনির চেয়ে গুড়ের হাট বড় ছিল।
কোটচাঁদপুরে শতাধিক কারখানায় হাজার হাজার লোক কাজ করতো। কেশবপুরে কারখানাপাড়া ও কলকাতাপট্টি ছিল। কলকাতার বড় ব্যবসায়ীরা এসে সেখানে চিনির ব্যবসায় করতেন। চৌগাছা ও ত্রিমোহিনীতেও বহু কারখানা ছিল। বাঘারপাড়ার ছাতিয়ানতলায় গুড়ের বড় হাট ছিল। শীতকালে প্রতি বৃহস্পতিবার একহাজারের বেশি গরুর গাড়িতে গুড় আসতো ওই হাটে। ছাতিয়াতলার মতো প্রায় সমান গুড়ের হাট ছিল কালীগঞ্জ,মণিরামপুর, ঝিকরগাছা, যশোর ও যাদবপুরে।
ইতিহাসের এক তথ্যে জানা যায়, কোটচাঁদপুরে ১৮৭৪ সালে ৬৩ টি চিনি কারখানায় ৯ লাখ ৩৮ হাজার ৮৫০ টাকা বিনিয়োগ করে এক লাখ ৫৬ হাজার ৪৭৫ মণ চিনি পাওয়া যায়। ১৮৮৯ সালে আট-নয় লাখ টাকা বিনিয়োগ কওে উৎপাদন হয় সাড়ে ১৭ হাজার মণ চিনি।
ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা চিনির ব্যবসায় করতে এখানে আসে। ব্লাক সাহেব নামে এক ব্যবসায়ী কোটচাঁদপুর ও ত্রিমোহিনীতে কুঠি স্থাপন করেন। সে সময় নিউ হাউজ সাহেব কোটচাঁদপুওে এবং সেন্টস বারিসাহেব ত্রিমোহিনী কুঠির দায়িত্ব পান। ওই সময় গ্লাসস্টোন ওয়াইলি অ্যান্ড কোম্পানি চৌগাছায় এসে চিনির কারখানা স্থাপন করেন। প্রথমে স্মিথ ও পরে ম্যাকলিয়ড কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন। ম্যাকলিয়ড প্রথমে স্থানীয় সব খেজুর রস কিনে নিয়ে গুড় ও চিনি তৈরি করতেন। কোটচাঁদপুর, কেশবপুর,তিমোহিনী, ঝিকরগাছা ও নারিকেলবাড়িয়ায় এই কোম্পানির কারখানা ছিল।
১৮৬১ সালে নিউহাইজ সাহেব চৌগাছা কারখানার শাখা হিসেবে তাহিরপুরে একটি চিনিকল স্থাপন করে ইউরোপীয় মতে চিনি তৈরি করতে থাকেন্ এর সাথে মদ তৈরি করার জন্য ভাটিখানাও যোগ হয়। এখানে উৎপাদিত চিনি জাহাজ ভর্তি করে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হতো। তাহেরপুর ভৈরব নদের জাহাজঘাটের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজো জাহাজ বেঁধে রাখার সেই পিলার এবং চিনি কারখানার পরিত্যক্ত জিনিসপত্র পড়ে আছে।
কিন্তু লোকসানের কারণে দেনা বাড়তে থাকলে ১৮৮০ সালে এমট চেম্বারস কোম্পানির কাছে কারখানা বিক্রি করে দেন। নতুন লোক এসে কারখানা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নয়ন করেন। তারা হাড়ের গুঁড়ো চিনি পরিষ্কার করার নতুন পদ্দতি চালুর চেষ্টা করেন। কিন্তু লাভজনক অবস্থায় ফিরতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে ১৮৮৪ সালে কোম্পানি উঠে গেল। বন্ধ হয়ে গের কারখানা। ওই সময় বালুচর নিবাসী রায় বাহাদুর ধনপতি সিংহ কারখানা কিনে নেন।১৯০৬ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত এ কারখানা চালু ছিল।