আজিজুল ইসলাম।
৬ই ফেব্রুয়ারি ,১৯৭৪ সাল। সেদিনের সকালের সূর্য্যটা প্রতিদিনের মতো পূবআকাশে ডগমগ করে তার কিরণ বিকিরণ করছিলো। প্রকৃতির সব কিছুই সেদিন একই নিয়মে শুরু হলেও সেদিনটা যে এত বেদনাবিধূর হবে সেকথা পশ্চিমা গ্রামের মানুষেরা ভাবতে পেরেছিলো? তারা কী ভেবেছিলো মানুষরুপি ভয়াল দানব তাদের শোকসাগরে ভাসিয়ে দিতে ওৎ পেতে আছে!
নিত্যকার দিনের মতো কৃষক লাঙ্গল নিয়ে মাঠে বের হয়ে গেছিল। দিনমজুরেরাও চলে গেছিলো যার যার কর্মে। স্কুলগামী ছেলে-মেয়েরা কোলাহল করতে করতে বেশিরভাগই স্কুলে পৌছেছিল ,আর কেউ কেউ তখনো পথে ছিল।
স্কুলের ঘন্টা বাজার আর বেশি বাকি নেই। নিজের বাইসাইকেলটা চালিয়ে প্রতিদিনের রুটিন মাফিক স্কুলের পথে আসছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আপন মনে সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে স্কুলের পথে আসা প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমান ভাবতেই পারেননি আজ তিনি স্কুলে পৌছাতে পারবেন না! তিনি ধারণাই করতে পারেন নি তার গমন পথের ধারে মৃত্যুদূত হয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে কিছু মানুষরুপি জানোয়ার। নিজের বাড়ি থেকে বেশ দূরে গাছগাছালি ঘেরা মাঠের মধ্যে পৌছান মাত্র শিক্ষক আজিজুর রহমানের সাইকেলের চলন্ত সাইকেলের চাকার ভেতর বাঁশ ঢুকিয়ে দেয়। এসময় তিনি মাটিতে পড়ে যান। আর ঠিক তখনই হায়েনারা তাঁর ওপরে হামলে পড়ে হাত মুখ বেঁধে রাস্তা থেকে নির্জন মাঠের মধ্যে নিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
এখবর কিছুক্ষনের মধ্যে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পৌছে যায় শিক্ষক আজিজুর রহমানের কর্মস্থলে। প্রিয় শিক্ষকের নির্মম খুনের খবর শোনার সাথে সাথে লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে খুনিদের ধরতে। তাদের সাথে যোগ দেয় গ্রামগঞ্জের আমজনতা। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত খোঁজাখুজিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে পলায়নরত কয়েকজন খুনিকে ধরে ফেলতে সক্ষম হন। গায়ে রক্তমাখা খুনিদের দু’জনকে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে আসার সময় মুখ ঢেকে রাখা স্বসস্ত্র একদল লোক ছাত্রজনতার হাত থেকে তাদের নিজেরা শ্বাস্তি দেবার কথা বলে ছাড়িয়ে নেয়। এরপর তারা ওই ঘাতক দু’জনকে স্থানীয় কুণ্ডু পাড়ার গভীর অরণ্যে গুলি করে হত্যা করে ফেলে যায়।
এরপরে উত্তেজিত ছাত্রজনতার হাতে ধরা পড়ে আরোও তিন খুনি। তাদের বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতারা পিটিয়ে ও গলা কেটে হত্যাকরে ফেলেন।
শিক্ষক আজিজুর রহমানের নির্মমখুনের সাথে জড়িত হিসেবে ছাত্রজনতার হাতে পাল্টা খুন হয় স্থানীয় বলরামপুর গ্রামের আব্দুর রশিদ,ওমর আলী,সোবহান,বাবু ও ওমর আলীর শ্যালক মাইজপাড়া।
নৃশংস এ খুনের ঘটনায় শিক্ষক আজিজুর রহমানের পরিবার থেকে বাঘারপাড়া থানায় ৩ জন কে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। আসামীরা হচ্ছে- বলরামপুর গ্রামের ইউছুপ বিশ্বাসের ছেলে নজরুল ওরফে নোয়াব ও কুদ্দুস ওরফে কুশই এবং ছব্দুল বিশ্বাসের ছেলে মন্টু বিশ্বাস। এদের মধ্যে নোয়াই ও কুশইয়ের যাব্জীবন কারাদন্ড হয় এবং মন্টু বিশ্বাস খালাস পান।
শহীদ শিক্ষক আজিজুর রহমান বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেল বাড়িয়া ইউনিয়নের পশ্চিমা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম গ্রহন করেন।মরহুম আমীন উদ্দিন শিকদারের ২ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে আজিজুর রহমান ছিলেন সবচাইতে মেধাবী । স্থানীয় নারিকেলবাড়িয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশের পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেন।
শহীদ শিক্ষক আজিজুর রহমান নড়াইল জেলার মল্লিকপুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের বজলুর রহমানের বড় কন্যা ফিরোজা বেগমের সাথে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি ৩ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক হন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে দুই মেয়ে গৃহিনী এবং এক মেয়ে শামছুন নাহার ডেইজি নারিকেল বাড়িয়া ডিগ্রী কলেজের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক । একমাত্র পুত্র সন্তান মিজানুর রহমান বাংলাদেশ পুলিশের একজন অত্যান্ত সৎ,নিষ্ঠাবান, চৌকস ব্রিলিয়ান্ট কর্মকর্তা। তিনি ডিআইজি হিসেবে ঢাকায় কর্মরত রয়েছেন।
শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন এবং শিক্ষকতা পেশ্যয় যোগ দেন। প্রথমে তিনি উপজেলার ধলগ্রাম হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদেন। এস্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতার পরে তিনি নারিকেলবাড়িয়া হাইস্কুলে চলে আসেন। গুণী এই শিক্ষকের স্পর্ষে প্রানবন্ত হয়ে ওঠে এলাকার বিদ্যালয়টি। তিনি অত্যান্ত দক্ষতার সাথে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করেন । কিন্তু ঘাতকের নির্মমহাতে স্কুলে আসার পথে ১৯৭৪ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হন। তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাণের প্রিয় শিক্ষকের মরদেহ পরম আদরে স্কুলচত্তরেই সমাধিস্ত করেন। কবরে শুয়ে যেন তিনি আজও শুনছেন তার প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘন্টা বাজছে ঢং ঢং ঢং আর সেই সাথে শিক্ষার্থীদের কোলাহল মুখরিত পদচারণা।