বিলাল হোসেন মাহিনী
শিক্ষায় মুক্তি মেলে। তার প্রমাণ, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজের আন্দোলন, বিজয় ও নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গন ছাত্র-শিক্ষক করো জন্যই সুখকর নয়। নানা বৈষম্যের আস্তাবরণে ঢাকা আমাদের শিক্ষা। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও শিক্ষায় এগিয়ে যাক। ফলপ্রসূ পরিবর্তন আসুক এ অঙ্গনে। এই প্রত্যাশায়…
একটি আধুনিক ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাইলে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হতো, তা হলো- ‘শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠন। কিন্তু শিক্ষক সমাজসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ গভির উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে, শিক্ষার সংস্কার প্রশ্নে নতুন সরকার একেবারেই উদাসীন। এনসিটিবি’র পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কমিটি গঠিত হল, কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সেখানে দেশের পঁচানব্বই ভাগ মানুষের চাওয়া উপেক্ষিত হল। অর্থাৎ, আলেম সমাজের প্রতিনিধি সেখানে অনুপস্থিত।
সামগ্রীক শিক্ষার আমূল পরিবর্তনে যেখানে শিক্ষা জাতীয়করণ করা অপরিহার্য; সেখানে ‘শিক্ষক দিবস’ পালন করে কী লাভ? বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর ‘শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়। কিন্তু কী পেয়ে থাকেন আমাদের সম্মানিত শিক্ষক সমাজ? শিক্ষার রূপান্তর বা পরিবর্তন শুরু হয় শিক্ষকদের দিয়ে। কিন্তু শিক্ষার পরিবর্তন শিক্ষকদের দিয়ে শুরু করতে হলে শিক্ষকের জীবন-মান উন্নত করতে হবে। শিক্ষকের মানের উন্নতির জন্য প্রয়োজন- বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা বৃদ্ধি ও পদোন্নতি প্রভৃতি।
বেসরকাররি শিক্ষক সংগঠনসমূহ থেকে দাবি করা হয়েছে- বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা, সরকারি বিধি অনুযায়ী বাড়িভাড়া, চিকিৎসাভাতা ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদানসহ শিক্ষা জাতীয়করণের। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রনালয় বা সরকারের পক্ষ থেকে একটি দাবিও কী আমলে নেয়া হয়েছে? শুধু তাই নয়, অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে হাজার হাজার শিক্ষক বিনা বেতনে বছরের পর বছর পড়াচ্ছেন, তাদের বেতন-ভাতাদি নিয়েও কী কোনো সুসংবাদ আছে? এখন প্রয়োজন জীবনমূখী মানসম্মত শিক্ষাক্রম, শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করা।
একজন শিক্ষক কিভাবে ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতায় ঈদ বা পূজা উদযাপন করবেন সরকারকে তা ভেবে দেখতে হবে।আমাদের শিক্ষকদেরও পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হতে হবে। শিক্ষার্থীদের সাময়িকভাবে ভয় দেখিয়ে, শারীরিক শাস্তি দিয়ে শেখানো যায় না। এটি একেবারেই পুরনো ধারণা। এই পেশায় এমন কিছু পাওয়া যায়, যা দুনিয়ার কোনো অর্থ বা সম্পদ দিয়ে পাওয়া যায় না। এ পেশার এমনই ধরন, এর মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেতে হলে শিক্ষকদের আরো গবেষণা করতে হবে, আরো ডেডিকেটেড হতে হবে, আর মোটিভেটেড হতে হবে। শিক্ষকগণ যখন নিজ পেশাকে প্রকৃত অর্থেই ভালোবাসবে, তখনই এ পেশায় পরিবর্তন আসবে।
শিক্ষকতা পেশায় সমস্যা অন্তহীন। বেতন-ভাতা, পদোন্নতিতে সরকারি-বেসরকারি খাতে পাহাড়সম বৈষম্য। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর করার কথা আছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে তার প্রতি আচরণ বিমাতাসুলভ। এবতেদায়ী মাদরাসার হাজার হাজার শিক্ষার্থী উপবৃত্তি বঞ্চিত। অন্যদিকে গত চার দশকে বাংলাদেশে শিক্ষকদের অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, এটা ঠিক। তবে সময় ও সমকালীন বিশ্বের তুলনায় তা এখনও আশাব্যঞ্জক নয়। এখনও মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসতে দ্বিধায় ভোগেন। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা অবসরে চলে যাচ্ছেন। এসব শূন্যস্থান যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে না। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মত হলো, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকারি কোষাগারে জমা করতে পারলে এবং শিক্ষার্থী প্রতি মাত্র ২০টাকা বেতন তুলতে পারলে দেশের সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে সরকারের এক পয়সাও অতিরিক্ত ব্যয় হবে না। অধিকিন্তু, উপকৃত হবে প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক।
লেখক-
পরীক্ষক, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর।