বিলাল হোসেন মাহিনী।।
রাষ্ট্র গঠন হয় নাগরিক, নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রমের রয়েছে কয়েকটি পর্যায়। ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান হয়ে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আজ বাংলার মানুষ নাগরিক হয়ে উঠছে, পেয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ।
আমাদের প্রথম স্বাধীনতা : পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে বাংলার প্রথম স্বাধীনতা অর্জন : পাকিস্তান গঠনকারী অঞ্চলগুলো (পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান) উনিশ শতকের অধিকাংশ সময় জড়ে ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিলো ১৯৪৭ সালের জুন মাসের ৩ তারিখে ভারতে ব্রিটেনের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে এক বৈঠকে ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা সম্বলিত ‘হোয়াইট পেপার’ বা ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করেন। শ্বেতপত্রে ভারতবর্ষ বিভক্তির রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল। ওই বৈঠকে সব দলের নেতৃবৃন্দ পরিকল্পনা মেনে নেন।
১৫ ই আগস্ট, ১৯৪৭ : দ্বিজাতি তত্ত্বের অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে দুইটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা হয়- ভারত এবং পাকিস্তান। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান (পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান) একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে আতপ্রকাশ করে। দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশগুলো নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার জন্য পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আন্দোলনটি পরিচালনা করে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, যার নেতৃত্বে ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ তারিখ মধ্যরাতটি ছিলো ২৭ রমজান ১৩৬৬ হিজরি, এই রাতটিকে মুসলমানগন পবিত্র রজনী হিসেবে বিবেচনা করেন । সেই থেকে ১৪ আগস্ট নিখিল পাকিস্তানের (পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান) স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আজকের তরুন প্রজন্ম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম মানে যে, পূর্ববাংলার তথা বাংলাদেশের প্রথম জন্মদিন (স্বাধীনতা দিবস), এই বিষয়টি জানেই না বা এর মর্ম উপলব্ধি করে না।
বাংলার দ্বিতীয় স্বাধীনতা : মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন : পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই বাংলার মানুষ স্বাধীকারের প্রথম বীজ বপন করেন ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ১৯৪৮ থেকে ‘৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন ও রাষ্ট্র ভাষা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা। ১৯৫৪ সালের ১০ই মার্চ, পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। ৩রাা এপ্রিল, ১৯৫৪ মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক শাসনভার গ্রহণ করে। ৭ই মে, ১৯৫৪ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে পূর্ববাংলার প্রধান ভাষা বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৬সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হয়। ১৯৫৫ভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতার অন্যতম দাবি ছিল বাংলা ভাষার প্রসার ও গবেষণার জন্য একটি স্বতন্ত্র একাডেমি স্থাপন করা। অবশেষে ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে বাংলা একাডেমী।
২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬ প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে বর্তমানে যেখানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবস্থিত, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। কিন্তু সেটি তখন গৃহীত হয়নি। ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭০ তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ৭ই মার্চ, ১৯৭১ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১৮ মিনিট ব্যাপী ভাষণ দেন। ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও, সেখানেই শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
২৬শে মার্চ, ১৯৭১ চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং ঐ বছর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড (মিত্র বাহিহী) গঠিত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটা এক মিনিটে রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ কম্যান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। এভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়।
তৃতীয় স্বাধীনতা : ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তৃতীয় স্বাধীনতা তথা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত শুরু : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সাথে যৌথ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দীর্ঘ লাড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একাত্তরে চূড়ান্ত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও সাধারণ মানুষ তাদের মৌলিক স্বাধীনতা পায়নি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নাগরিক হিসেবে মানুষ তার অধিকারের সংগ্রাম করে গেছেন। ‘৯০ এর গণতান্ত্রিক উত্তরেণের স্বৈরাচার পতন আন্দোলন থেকে শুরু করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ২০২৪এর বিপ্লব অবধি সংগ্রাম করে গেছেন বাংলার মুক্তিকামী জনতা। জুলাই গণহত্যাকান্ড- বলতে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণঅভুত্থানের সময় ফ্যাসিস্ট সরকারের চালানো দমনপীড়ন ও ব্যাপক হত্যাকা-কে বোঝায়। বিতর্কিত কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল ও ব্যাপক গণঅসন্তোষের জের ধরে এই গণহত্যা অভিযান পরিচালনা করে আওয়ামী লীগ সরকার ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন: পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীর একাংশ আর ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং(র)। উক্ত সংঘর্ষের ফলে ব্যাপক প্রাণহানী সংঘটিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, দলীয় সদস্য, পথচারী এমনকি শিশুরাও। আগস্টের শুরুর দিকে এই সহিংসতার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে, প্রাণহানির সংখ্যা কয়েক হাজার পর্যন্ত অনুমান করা হয় এবং আহতের সংখ্যা প্রায় অর্ধ লক্ষ।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন সহিংস হয় ১৫ জুলাই থেকে। তবে জুলাইয়ের শেষ থেকে ৫ আগস্টে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন পর্যন্ত ঘটে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা। ১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। বেলা দেড়টার একটু পরেই তাঁরা ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের একটি গাড়িতে বেরিয়ে আসেন। এমতাবস্থায় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ২ আগস্ট, শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুমার নামাজের পর ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালিত হয়। দেশের প্রায় সব জেলা ও মহানগরে পালিত হয় এই কর্মসূচী। শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি পালন। শিল্পীসমাজের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে শামিল হন সর্বস্তরের মানুষ। ৩ আগস্ট, শনিবার- সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ হাজারো জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ। ৪ আগস্ট, রোববার- সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনে সারা দেশে ব্যাপক সংঘাতের খবর পাওয়া যায়। ৫ আগস্ট, সোমবার- ঢাকামূখী ছাত্র-জনতার গণস্রোত ও গণঅভ্যূত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অর্ন্তবতী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন এবং গণভবন, সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে অসংখ্য মানুষ। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে আগুন, আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুদ্ধ জনতা। এভাবে বাংলাদেশ নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যায়। মানুষ ফিরে পায় নাগরিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতা।