মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার।
সোনাতলার নামকরণের বয়স প্রায় পৌনে তিন শত বছর। এই নামের উত্পত্তির সঠিক ইতিহাস না থাকার কারণে বিভিন্ন মতান্তর ও কিংবদন্তি সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া সোনাতলার নামকরণ সম্পর্কে তেমন কোন দালিলিক প্রমাণ সরকারের হাতে নেই। তবে ‘সোনাতলা’ নামটি কীভাবে এলো, তা নিয়ে এবং পর্যাক্রমে ইতিহাসের কিছু তথা উপাদান সংগ্রহ করে ময়মনসিংহের গৌরীপুরস্থ এসিক এসোসিয়েশন (ACECC Association ), ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি এন্ড লাইব্রেরি এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে আসছে। মুঘল সম্রাটের শাসনকার্য বিস্তারে ২৪টি পরগনার মধ্যে ঘোড়াঘাট একটি পরগনা। ঘোড়াঘাট পরগণায় রাজা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী তলাপাত্র তার নাতির স্মৃতিকে অবিস্মরনীয় করে রাখার জন্য বগুড়ার একটি স্থানের নাম রাখা হয় সোনাতলা। বর্তমান সোনা রায়ের স্মৃতিচিহ্ন সোনাতলা উপজেলা। সোনা রায়ের জন্মের প্রথম ব্রাহ্মণ নাম ছিল সোনা তলাপাত্র ; সোনা রায়ের বাবার নাম রায় রায়ান চাঁদরায় এবং পূর্ব নাম চন্দ্রকিশোর তলাপাত্র । নবাব আলিবর্দী খাঁর দরবারে বিশ্বাসত্ব কর্মকর্তা হিসেবে তার নতুন নাম রাখা হয় ‘রায় রায়ান চাঁদরায়’। আড়াইশত বছর আগের রেনেলের কয়েকটি মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায়, তৎকালীন বগুড়ার এলাকার দিকে দৃষ্টি দিলে ঘোড়াঘাট পরগণায় শিবগঞ্জ হতে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক’ রোড মোকামতলা, বালুয়া এবং বাঙ্গালা বা বাঙ্গালী নদীর ধারে আড়িয়া নামে প্রাচীন জনপদ বা প্রসিদ্ধ স্থানের নাম পাওয়া যায়। বাঙ্গালী নদীর মাধ্যমে ইসলামাবাদ নামে একটি রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তাছাড়া সে সময় ঘোড়াঘাট পরগণায় ঘোড়াঘাট সরকার চালু করে সমগ্র উত্তর অঞ্চল শাসন ব্যবস্থা বিস্তারিত ছিল। বর্তমানে সোনাতলা নামে যে জায়গাটি উপজেলা হিসেবে অবস্থান পূর্বে তা ‘বালুয়া’ ও ‘আড়িয়া’ নামে বন্দর হিসেবে সুপরিচিত ছিল।‘বালুয়া’ ও ‘আড়িয়া’ এই দু’টি বন্দরের মাঝে সোনাতলা স্থানের উৎপত্তি। বর্তমানে ‘আড়িয়া’ একটি নদীর ঘাট । সোনাতলা মৌজার নামানুসারে সোনাতলা রেল স্টেশন নামকরণ করা হয়েছে। মৌজার নামকরণ সর্ম্পকে যতটুকু জানা যায়, তা হলো ঘোড়াঘাট চাকলায় কোনো দুর্দান্ত মুসলমান জমিদারের বিধবা স্ত্রী বেগম রানী চাঁদরায়ের ব্যবহারে ও প্রেমের প্রতিদানে খুব রাগান্বিত হলেন এবং চাঁদরায়ের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মনস্থ করলেন। তার ছেলে সোনা রায় তলাপাত্র ১৬ বছরে পরিপূর্ণ হলো। বিবাহযোগ্য ছেলে হওয়ার আগেই বেগম রানী কোনো উপায় না দেখে চাঁদরায়ের পুত্র সোনা রায়কে ধরে আনার জন্য বগুড়ার আদমদিঘির কড়ই রাজ্যে গুপ্তভাবে কয়েকজন অস্ত্রধারী সৈন্য প্রেরণ করেন। অবশেষে রাজপ্রাসাদ থেকে সোনা রায় কোনো উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। এই সুযোগে সৈন্যরা সোনা রায়কে রাস্তা থেকে ধরে বেগম রানীর কাছে আনেন। বেগম রানী সোনা রায়কে বন্দি করে এই মৌজার এক নিরাপদ স্থানে অতি সাবধানতার সঙ্গে রক্ষা করেন এবং তার রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে করাতে স্থির করেন। মুসলিম দিনপুঞ্জি ও চাঁদ উঠার তারিখ অনুসারে সোনাতলায় বিবাহের দিন ধার্য হলো। কড়ই রাজবাড়ির রাজা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী তলাপাত্র তার অতি আদরের নাতি সোনা তলাপাত্রকে খোজতে বিভিন্ন স্থানে লোক পাঠান। উল্লেখিত বালুয়া হচ্ছে বর্তমান সোনাতলা উপজেলার বালুয়া ইউনিয়ন এবং আড়িয়া হচ্ছে সোনাতলার কাছে একটি নদীর ঘাট। বর্তমানে আড়িয়া বন্দরের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেলেও তা বগুড়া জেলার রানীপাড়া গ্রামের কাছে সোনাতলাকে ইতিহাসের সোনালী পাতায় স্থান করে দিয়েছে। সোনারায় নামে একটি লোকগাথা ১১৫ বছর আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। এই অমর লোকগাথা প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির পূর্বে বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে গীত হয়ে কাহিনীর প্রচলন ছিল।
সোনারা’র বিয়া
“বার বার যায় মালিয়ান
ফুলের লাগিয়া।
কোন চাঁদে হল নারে
সোনারা’র বিয়া।
চাঁদরায় চাঁদরায় কি কর বসিয়া
তোমার পুত্র মাইর খায় সেখানে বসিয়া।।”
সরেজমিন ও গবেষণার মাধ্যমে সোনাতলা নামকরণের বিস্তারিত ইতিহাস আপনাদের সামনে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলোঃ
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর পিতা জমিদার জয়নারায়ণ তলাপাত্রঃ
বগুড়ার আদমাদিঘির কড়ই রাজবাড়ি স্থানীয় ও জাতীয় ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায়।আদমদিঘি উপজেলার কুন্দগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ রাজবাড়িটি শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কড়ই রাজবাড়ি হিসাবেও সুপরিচিত। ইতিহাস আর ঐতিহ্যেঘেরা কড়ই (করৈ) গ্রামে রয়েছে প্রাচীন সব নিদর্শন। আর রয়েছে তৎকালীন ব্রাহ্মণ রাজা-জমিদারদের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
ব্রাহ্মণ জমিদার যজ্ঞেশ্বর ও জয়নারায়ণ দুই ভাই পারস্য ভাষায় শিক্ষালাভ করে নবাব সরকারের কর্মলাভ করেন। তাদের দক্ষতা, কর্তব্য ও প্রতিভার গুণে নবাবের প্রিয়পাত্র হয়ে “তলাপাত্র” উপাধি লাভ করেন। নবাবের অনুগ্রহে তরফ করৈ শেলবর্ষ ও ছিন্দাবাজু পরগনার অন্তর্গত ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়ে নাটোর থেকে বগুড়ার আদমদিঘির কড়ই (করৈ) গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন।এই সম্পত্তি পূর্বে সৈয়দ আলী চৌধুরী নামক এক মুসলমান জমিদারের অধিকারে ছিল।কালক্রমে উক্ত সৈয়দ আলী চৌধুরীর কোনো বংশধর না থাকায় ঐ জমিদারি নবাব সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।তারপর যজ্ঞেশ্বর ও জয়নারায়ণ তলাপাত্র নবাব সরকারের উপযুক্ত নজরাদি দিয়ে ওই জমিদারির মালিক হন। জ্যেষ্ঠ যজ্ঞেশ্বর নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কনিষ্ঠ জয়নারায়ণ তলাপাত্রের ঔরসে তিলোতমা দেবীর গর্ভে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন।উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত গৌরীপুরের রামগোপালপুরের জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তার জীবদ্দশায় কড়ই গ্রামে তৎকালীন জমিদারদের সুবৃহৎ বাসভবনের ভগ্নাবশেষ বিপুল সমৃদ্ধির পরিচয় দিচ্ছিল। জয়নারায়ণ তলাপাত্রের একমাত্র পুত্রসন্তান শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সময়ে এই বাসভবনের একাধিক উন্নতি সাধিত হয়েছিল। জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে কড়ই (করৈ) রাজবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে।কড়ই রাজবাড়ি সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – ‘‘ঐ বাসভবনটি অতি বৃহৎ, চতুর্দিকে পরিখাপরি বেষ্টিত।কালের কঠোর হস্তে ইহার পূর্বের শোভা সৌন্দর্য সমস্ত বিনষ্ট হইয়াছে বটে, কিন্তু এখনও যাহা আছে তাহাতেই শিল্পপ্রিয় ব্যক্তিগণের হৃদয় মুগ্ধ হইতে পারে।দুইশত বা আড়াইশত বৎসর পূর্বে আমাদের দেশে স্থপতিকার্য কিরূপ নিপুণতার সহিত সম্পন্ন হইত উক্ত বাসভবন দৃষ্টে তাহা বিশেষ রূপে উপলব্ধি হয়।চতুর্দিকে বিস্তৃত পরিখা ও তাহার পার্শ্বে সুদৃঢ় প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ এখনও যাহা বর্তমান আছে তাহা দেখিলে ইহা যে বহিঃশত্রুর দুষ্প্রবেশ্য দুর্গের ন্যায় সুরক্ষিত ছিল তাহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়।’’
রেনেলের মানচিত্রে আদমদিঘি ও কড়ই (করৈ>কড়রি):
বাংলার মানচিত্রের পথিকৃৎ মেজর জেমস রেনেল। জেমস রেনেল অংকিত মানচিত্র বাংলার প্রাচীন মানচিত্র।বাংলাদেশে ইতিহাস বিভাগে “Rennells Bengals Atlas” এই বিশাল মানচিত্র একসময়ে দুষ্প্রাপ্য ছিল।শত শত বছরের প্রামাণ্য ইতিহাস রয়েছে আদমদিঘি ও কড়ই গ্রামে।এ রকম প্রাচীন ও সুস্পষ্ট ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ময়মনসিংহের গৌরীপুরে অবস্থিত ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি ও লাইব্রেরি এবং দিইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স নামে সংগঠনগুলো কাজ করছে।সংগঠনের মাধ্যমে অজানাকে জানার জন্য ইতিহাসের অপ্রকাশিত অধ্যায়, তথ্যসূত্র, জনশ্রুতি, প্রাচীন মানুষের কথা, ঝরেপড়া অপ্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ, প্রাচীন দুর্লভ তথ্য ও প্রাচীন মানচিত্র সংগ্রহ ও গবেষণার মাধ্যমে আপডেট ইতিহাস রচনা করা হয় বা হয়ে থাকে।
প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এসিক এসোসিয়েশন ও ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশনের সহযোগিতায় প্রতিবছর একটি স্বনামধন্য আঞ্চলিক তথ্যবহুল ম্যাগাজিন ‘পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স’প্রকাশিত হয়।ম্যাগাজিনে প্রকাশিত রেনেলের আড়াইশত বছর আগের কয়েকটি মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায়, তৎকালীন বগুড়ার এলাকার দিকে দৃষ্টি দিলে আদমদিঘি এবং কড়রি নামে প্রাচীন জনপদ বা প্রসিদ্ধ স্থানের নাম পাওয়া যায়।কড়ই পূর্বে করৈ বা কড়রি উচ্চারণ করা হতো বলে জানা যায়। আজকাল কড়ইয়ের অবস্থা দেখলে তা ভাবতেও কষ্ট হয়।
শ্রীকৃষ্ণ তলাপাত্র কর্তৃক বিদ্রোহ দমন ও মোমেনসিং (ময়মনসিংহ) পরগনা প্রাপ্তি:
শ্রীকৃষ্ণ তলাপাত্র অত্যন্ত মেধাবী ও অসাধারণ বলবান ছিলেন। মুঘল আমলে রাজানুগ্রহ লাভ করতে হলে ফারসি ভাষা শিখতে হয়। শ্রীকৃষ্ণের পিতা, পিতামহ সকলেই নবাব সরকারে চাকরি করে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ ও পিতৃপথানুসরণ করে নবাব দরবারে পরিচিত ও প্রতিপন্ন হবার উদ্দেশ্যে পারস্য ভাষা শিক্ষা লাভ করে প্রথম যৌবনে তিনি স্বীয় বিষয়সম্পত্তির তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিছুদিন পর শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মুর্শিদাবাদে গমন করাই স্থির করলেন।নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে কোন পরাক্রান্ত জমিদার অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেন ও নবাবকে উপেক্ষা করে স্বীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার দমনের জন্য নবাব সৈন্য প্রেরণ করেন।
একজন বিদ্রোহী জমিদার দমনের জন্য শ্রীকৃষ্ণের উপর ভার অর্পণ করা হয়। শ্রীকৃষ্ণ সৈন্যদল নিয়ে ঐ স্থানে উপস্থিত হন এবং সেখানে শিবির স্থাপনপূর্বক পূর্বোক্ত বিদ্রোহী জমিদারের নিকট বন্ধুভাবে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, “সম্রাটের আদেশ মত আমি পূর্ণিয়ায় নবাবকে গ্রেফতার করার জন্য যাওয়া হচ্ছে, আপনি শক্তিমান এবং সম্রাটের হিতৈষী, আপনার সাহায্য পাওয়ার জন্য সম্রাটের আদেশ আছে। অতএব আপনি আমাকে সৎপরামর্শ ও সাহায্যদানে বাদসাহের কার্যসাধন ও নিজের স্বার্থ-সাধন করবেন।ভরসা করি এই সুযোগ ত্যাগ করবেন না।”
বিদ্রোহী জমিদার এ প্রস্তাবে অন্ধ হয়ে নবাব হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন। নিজের সামান্য শক্তিকে তিনি প্রবল শক্তি বলে বোধ করলেন, তার ক্ষমতার কথা সম্রাট জানতে পেরেছেন এবং সাহায্য পর্যন্ত চেয়েছেন, এ কি কম কথা! পুর্ণিয়ার নবাবের পদে তাকে স্থাপিত করা বাদশাহের ইচ্ছা হতে পারে।এইরূপ স্বপ্নে কুয়োর মধ্যে তিনি পড়ে গেছেন এবং জমিদার শ্রীকৃষ্ণের জালে পড়লেন। তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য শিবিরে হাজির হলেন।শ্রীকৃষ্ণ তাকে গ্রেপ্তার করে মুর্শিদাবাদে নবাব দরবারে নিয়ে যান। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ শ্রীকৃষ্ণের এইরূপ কার্য কুশলতা দেখে খুব খুশি হলেন এবং দিল্লির সম্রাটের নিকট এই বিদ্রোহ দমনের বিষয় জানালেন।
পরে দিল্লির বাদশাহ শ্রীকৃষ্ণের পদোন্নতি ও যথোপযুক্ত পুরষ্কার প্রদান করতে আদেশ দিলেন।ঐ সময় শ্রীকৃষ্ণ চেীধুরী সরকার বাজুহার অন্তর্গত মোমেনসিং (ময়মনসিংহ) পরগনা প্রাপ্ত হলেন। জঙ্গলবাড়ির দেওয়ান বংশের প্রতিষ্ঠাতা ঈশা খাঁ পূর্বে এই মোমেনসিং বা মোমেনশাহী পরগনার অধিকারী ছিলেন।ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগরে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর ২য় বাসস্থান স্থাপন:
এক সময় কেল্লা বোকাইনগর ও কেল্লা তাজপুর বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধ্যে দুইটি প্রধান স্থান ছিল। ধনে, জনে, ঐশ্বর্যে, সভ্যতায় এই দুই স্থানই তখন শ্রেষ্ঠ ছিল। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বোকাইনগর কেল্লার উপকণ্ঠে বাসাবাড়ি (বাশেঁরবাড়ি>বাদশারবাড়ি) এলাকায় তার বাসস্থান নির্বাচন করেন। পূর্বে যে স্থানে তার ২য় রাজবাড়ি, কাছারী, পরগনার প্রধান কাননগো অফিস নির্মিত হয়েছিল, ঐ স্থানেই তার ঐতিহ্যের উপযুক্ত আবাস গৃহাদি নির্মিত হয়েছিল। এখনও ঐ স্থান বোকাইনগর বাসাবাড়ি নামে পরিচিত। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশের একটি শাখা যেমন তার কনিষ্ঠ ছেলে লক্ষীনারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণের তিন ছেলে শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দ চন্দ্র ও রুদ্র চন্দ্র ঐ বাসাবাড়িতে বাস করে পূর্বপুরুষের বাসস্থান নির্বাচনের গৌরব অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র ও সোনারায় ( সোনা তলাপাত্র) এর পিতা তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁ’র দরবারের খালসা বিভাগের প্রধান কর্মচারী চাঁদ রায়ঃ
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ রায় চন্দ্র কিশোর তলাপাত্র নামে পরিচিত ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের পিতা, পিতামহ সকলেই নবাব সরকারে চাকরি করে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণও পিতৃপথানুসরণ করে নবাব দরবারে পরিচিত ও প্রতিপন্ন হওয়ার উদ্দেশ্যে ফারসি ভাষা শিখে প্রথম যৌবনে তিনি নিজ বিষয়সম্পত্তির তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং পরে মুর্শিদাবাদে গমন করবেন বলে স্থির করলেন। পরবর্তীতে নবাব সরকারে তার জ্যেষ্ঠ ছেলে চাঁদ রায় চৌধুরী প্রথমে জনাব রায় রায়ান আলম চাঁদ-এর সহকারী সচিব হিসেবে চাকরি নেন এবং জনাব আলম চাঁদের মৃত্যুর পর ‘রায় রায়ান’ উপাধিসহ খালসা বিভাগের রাজস্ব বিষয়ক সচিবের পদে অভিষিক্ত হন। শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে তিনি বড়ই সুপুরুষ নির্ভীক ও অসাধারণ বলবান ছিলেন। সোনারায় ( সোনা তলাপাত্র) এর পিতা চাঁদ রায় ঘোড়াঘাটে একটি বিদ্রোহ দমন করে নবাব আলিবর্দীর প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন। চাঁদ রায়ের চেষ্টা ও উদ্যোগে জাফরশাহী পরগণা মোমেনসিং পরগণার সাথে অন্তর্ভুক্ত করেন। মোমেনসিং পরগণার জন্য যে রাজস্ব নির্ধারিত ছিল, মোমেনসিং পরগণা ও জফরশাহী উভয় পরগণার জন্য ঐ রাজস্বই নির্দিষ্ট হলো। এক পরগণার রাজস্ব দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী দুইটি সুবৃহৎ পরগণা ভোগ করবার অধিকার প্রাপ্ত হলেন। নবাব যুগে অশ্বারোহণে, তীর, তরবারি পরিচালনা প্রভৃতি বীরত্বপূর্ণ কাজে ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
নবাব আলীবর্দী খাঁ’র হুকুমে চাঁদরায় কর্তৃক ঘোড়াঘাট চাকলায় এক বিদ্রোহী মুসলিম জমিদারের শিরচ্ছেদ ও রাজার স্ত্রী বেগম রানীর প্রেমকাহিনী:
ব্রাহ্মণ যুবরাজ রায় রায়ান চাঁদরায় সম্বন্ধে অনেক গল্প ও কবিতা প্রচলন আছে। ঘোড়াঘাট চাকলায় কোনো দুর্দান্ত মুসলমান জমিদারের শাসনের জন্য এবং তাকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য নবাব আলিবর্দী খাঁ তার বিশ্বাসত্ব কর্মকর্তা চাঁদরায়কে প্রেরণ করেন। বুদ্ধিমান চাঁদরায় হত্যাকাণ্ডের যুদ্ধ বা লোকক্ষয়কর যুদ্ধের অনুষ্ঠান অপেক্ষা কৌশলে কার্যসিদ্ধি করতে সাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন এবং নবাবের কতগুলো উন্নতমানের ঘোড়া নিয়ে ঘোড়া ব্যবসায়ীরূপে চাকলায় জমিদারের রাজ্যে উপস্থিত হন। কিছুদিন সেখানে বাস করতে শুরু করেন এবং অসহায় ও গরীবদের বহু অর্থ দিয়ে সাহায্য সহায়তা করেন। অনেক গরীব লোকদের অভাব মোচন করেন এবং জমিদারের কর্মচারীদেরকে অর্থে ও সৌজন্যে বশীভূত করেন। এমন সওদাগরের অপরূপ রূপ, অপূর্ব দানশক্তি ও অর্থের প্রচুরতা দেখে স্থানীয় লোকজন তাকে কোন ছদ্মবেশি রাজপুত্র বলে মনে করতেন। তার পৃষ্ঠপোষক লোকের অভাব ছিল না। পর্যাক্রমে এই খবর জমিদারের কানে পৌঁছাল। রাজার স্ত্রী বেগম রানী তাকে দেখতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
চাঁদরায় জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে হাজির হলে রানী তাকে দেখে স্তম্ভিত হলেন এবং তার রূপ-লাবণ্যে মোহিত হলেন। যেমন রহস্যময় এক রাজপুত্র, তেমনি রহস্যময় তার প্রেম। রানীও ছিলেন পরমাসুন্দরী হিসেবে সেসময়ের ট্রয় নগরের হেলেন বা ক্লিওপেট্রার মতো এক রহস্যময়ী নারী। তখন চাঁদরায় তার লক্ষ্য ও সুবিধা অন্বেষণ করতে লাগলেন। বেগম রানীর হাবভাব বুঝে তার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে লাগলেন। তাদের প্রেম গভীর হওয়ার পর রূপে পাগল বেগম রানী ব্রাহ্মণ রাজপুত্র চাঁদরায়ের প্রতি এতই অনুগত হলেন যে, তার নিজ স্বামীর জীবন নাশের প্রস্তাবে সম্মতা হলেন। চাঁদরায় রানীর কৌশলে গুপ্তভাবে অন্দরমহলে প্রবেশ করেন এবং নিদ্রিত অবস্থায় জমিদারকে হত্যা করে রাজপ্রাসাদ থেকে বাহিরে যাবার সময় বেগম সাহেবা জিজ্ঞাসা করেন, “মেরা ওয়াস্তে কৌন হ্যায়”। চাঁদরায় উত্তর করেন, “তোমহারা ওয়াস্তে হাম হ্যায়।” বেগম রানী চাঁদরায়কে নিরাপদে অন্দরমহল থেকে বাহির করতে সাহায্য করেন। পরদিন চাঁদরায় সৈন্যসামন্ত-সহ রাজবাড়ি বেষ্টন করেন, কিন্তু জমিদারের মৃত্যুতে পরিবারবর্গ শোকার্ত ও শঙ্কিত হয়েছিল বলে সহজেই চাঁদরায়ের বশ্যতা স্বীকার করেন। বেগম রানীর সঙ্গে যে প্রেম ঘটনা ঘটেছিল, তা রক্ষার জন্য তিনি তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার গ্রহণ করেন। তারপর চাঁদরায় নিহত জমিদারের মুণ্ডটি নবাব দরবারে আনয়ন করেন। নবাব আলিবর্দী খাঁ চাঁদরায়ের কাজের প্রতি খুশি হয়ে উপযুক্ত পুরস্কার প্রদান করলেন। তখনকার থেকেই মুসলমান জমিদারের স্ত্রী বেগম রানী এবং ব্রাহ্মণ রাজপুত্র চাঁদরায়কে নিয়ে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন গান ও গীত।
সামাজিক কারণে চাঁদরায় বেগম রানীকে বিয়ে ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে অস্বীকার এবং রাণী কর্তৃক চাঁদরায়ের ছেলে সোনা রায়কে বন্দী করে নিয়ে আসা:
আমরা সকলেই জানি কোনো এক সময় কোনো রাজা বা যুবরাজ অন্য কোনো রাজ্য দখল করলে সে রাজ্যের পরাজিত রাজার স্ত্রীকে বিয়ে করতেন। যেমন রাজা ইডিপাস। প্রবাদ আছে যে, ‘বিধির লিখন যায় না খন্ডন’।ভাগ্যে লেখা থাকলে দুর্ভোগ পোহাতে হবেই। নিয়তি যেভাবে মানুষকে নিয়ে খেলবে, মানুষ সেভাবেই খেলবে। মানুষ হলো পুতুল। যুবরাজ চাঁদরায়ের ছেলে সোনা তলাপাত্র (সোনা রায়) ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তানের মা মৃত্যুবরণ করেন। এখানেই চাঁদরায়ের জীবনে ট্র্যাজেডি নিহিত। প্রসূতি সময়ে যুবরাজ চাঁদরায়ের পত্নীর অকাল মৃত্যু, বেগম রানীর প্রতি অনুরাগ, ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল, বিভিন্ন সামাজিক চাপ ইত্যাদি কারণে তিনি তার নিজের মনকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। এমনকি তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে রাজি হননি। কিছুদিন সময় অতিবাহিত হলে চাঁদরায় উক্ত বেগমের বিয়ে ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার বহন করতে অস্বীকার করেন। বেগম রানী চাঁদরায়ের ব্যবহারের খুব রাগান্বিত হলেন এবং চাঁদরায়ের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার মনস্থ করলেন।
জীবনযন্ত্রণায় সূর্যের মতোই তেজ রানীর। চাঁদরায় মুর্শিদাবাদ নবাব প্রাসাদ থাকে রাজকার্য করেন অতএব সেখানে তাকে প্রতিশোধ নেওয়া দুরূহ ব্যাপার। এভাবে দিন পেরোতে পেরোতে সোনা রায় ১৬ বছরে পরিপূর্ণ হলো। বিবাহযোগ্য ছেলে হওয়ার আগেই বেগম রানী কোনো উপায় না দেখে চাঁদরায়ের পুত্র সোনা রায়কে ধরে আনার জন্য বগুড়ার কড়ই রাজ্যে গুপ্তভাবে কয়েকজন অস্ত্রধারী সৈন্য প্রেরণ করেন। অবশেষে রাজপ্রাসাদ থেকে সোনা রায় কোনো উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। এই সুযোগে সৈন্যরা সোনা রায়কে রাস্তা হতে ধরে বেগম রানীর কাছে আনেন। বেগম রানী সোনা রায়কে বন্দি করে কোনো এক নিরাপদ স্থানে অতি সাবধানতার সঙ্গে রক্ষা করেন এবং তার রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে করাতে স্থির করেন। মুসলিম দিনপুঞ্জি ও চাঁদ উঠার তারিখ অনুসারে বিবাহের দিন ধার্য হলো। রাজপুত্র সোনা রায় নানারূপ আপত্তি দেখিয়ে ক্রমে কিছুদিন অতিবাহিত করলেন। কোনো একদিন এক প্রহরীকে নিজের স্বর্ণ অঙ্গুরীয় উৎকোচ স্বরূপ প্রদান করে অব্যাহতি লাভ করেন। যে স্থানে সোনারায়কে বন্দি করে হয়েছিল সে স্থানে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার নামকরণ করা হয় শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর অতি আদরের প্রথম পৌত্র (নাতি) সোনা তলাপাত্র বা সোনা রায় এর নামানুসারে। তা ছাড়াও জমিদার শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর সময়ে রাজকন্যার সঙ্গে সোনা রায়ের বিবাহ সম্বন্ধে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে লোকগাথা প্রচলিত ছিল। এই অমর লোকগাথা প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির পূর্বে বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে গীত হয়ে কাহিনীর প্রচলন ছিল।
লাল লাল সেহঁড়া মাথে
পাটের পরণ নিয়া সাথে
ওলো বেগম সাহেব
কি কর বসিয়া।
তোমার বেটির দামান্দ আ’ল
দোলায় সাজিয়া।
মালী ভাই চাঁপ ফুল
দিয়াছে আনিয়া।
আবার চলিল মালিয়ান
ফুল আনিবার।
দুই ডালা ভরে ফুল
আনিল সোলার।
সেও ফুলে হল নারে
বিয়া সোনারার
ফের চলিল মালিয়ান
ফুলের লাগিয়া।
আনিল গেন্দার ফুল
ডালায় সাজিয়া।
সেও ফুলে হল নারে
সোনারা’র বিয়া।
বার বার যায় মালিয়ান
ফুলের লাগিয়া।
কোন চাঁদে হল নারে
সোনারা’র বিয়া।
চাঁদরায় চাঁদরায় কি কর বসিয়া
তোমার পুত্র মাইর খায় সেখানে বসিয়া।
বেগম রানীর প্রতি শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর ক্রোধ এবং সোনা রায়ের জন্মের সময় স্ত্রীর মৃত্যুর পর চাঁদরায়ের দ্বিতীয় বিবাহে অসম্মতির কারণ ও প্রবাদ:
আদরের পৌত্র (নাতি) সোনা রায় মুক্তিলাভ করে কড়ই রাজবাড়িতে পৌঁছলে বৃদ্ধ শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বেগম রানীর প্রতি খুব রাগান্বিত হলেন এবং অবিলম্বে তার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। কিন্তু বেগম রানীর এই ঘটনার কিছুদিন পর অন্য কোথাও যাওয়াতে শ্রীকৃষ্ণের ক্রোধ কমতে কমতে বিলীন হয়ে গেল। চাঁদরায়ের একমাত্র পুত্র সোনা রায়ের জন্মের পর তাঁর পত্নী মৃত্যবরণ করেন, তারপর তিনি আর বিবাহ করেননি। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বিয়ের জন্য অনুরোধ করলে তিনি বলেছিলেন, “আপনার ছয় পুত্র। যদি আমি বিবাহ করে বংশ বৃদ্ধি করি, তবে ভবিষ্যতে আপনার সম্পত্তি খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। আমার একমাত্র পুত্র সোনা রায় বর্তমান আছে, তারপরে বিবাহ করা কি দরকার ?” রামগোপালপুর জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘‘পত্নী-বিয়োগকালে চাঁদরায়ের বয়স অধিক হয় নাই। বিদ্যা, বুদ্ধি, শক্তি, পদমর্যাদা, সর্ব বিষয়েই তিনি ভাগ্যবান ছিলেন। এমন রূপবান, গুণবান পুরুষ এত অল্প বয়সে পত্নীহারা হইয়া বিবাহ করিতে অনিচ্ছুক, অবশ্যই ইহার মধ্যে কোনও কারণ আছে। কল্পনার শত শাখা শত পথে চলিল। শেষে সিদ্ধান্ত হইল, চাঁদরায় উক্ত মুসলমান দুর্দান্ত জমিদারকে হত্যা করার সময় অবশ্যই বেগমের প্রণয়ে মোহিত হইয়াছিলেন, নচেৎ বিবাহে অমত হইবার আর কারণ কি আছে? অলীক কল্পনা এইরূপ ক্ষীণ ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠা লাভ করে।’’
মোমেনসিং পরগনায় প্রজাবিদ্রোহ দমনের জন্য প্রথমে বোকাইনগর বাসাবাড়িতে আগমন এবং নেত্রকোণার নন্দীপুর গ্রামে চাঁদরায়ের নতুন বাসস্থান নির্মাণ:
রণনায়ক চাঁদরায় বৃদ্ধ পিতার আদেশ অনুসারে বগুড়ার আদমদিঘি উপজেলায় অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কড়ই রাজবাড়ি হতে ময়মনসিংহের গৌরীপুরের বোকাইনগর বাসাবাড়ির দিকে যাত্রা করেন। বোকাইনগরে অবস্থিত বাসাবাড়ি শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মোমেনসিং পরগানার প্রধান কাননগো অফিস, কাছারি ও ২য় রাজবাড়ি ছিল। চাঁদরায় পরবর্তীতে মোমেনসিং পরগনার মধ্যস্থলে জমিদারি কার্য পরিচালনা এবং প্রজাবিদ্রোহ দমনের জন্য বর্তমান গৌরীপুর উপজেলার সীমানায় ঘেষা নেত্রকোণার মদনপুর ও বেখৈরহাটির কাছে নন্দীপুর গ্রামে একটি বাসস্থান নির্মাণ করেন।
বর্তমান (২০২৪) তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁ’র আমলে রণনায়ক চাঁদরায় কর্তৃক প্রায় ২৪ বিঘা (৭৯০ শতাংশ) আয়তনের সুবিশাল দিঘিটি রয়েছে। দিঘির পাড়সহ ৪০টি বাড়ির জন্য গুচ্ছগ্রামের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন বাংলাদেশ সরকার। এখনও রণনায়ক চাঁদরায় কর্তৃক ২৪ বিঘা দিঘিটি অতীত গৌরবের নিদর্শন হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গুচ্ছগ্রামের নন্দীপুর আদর্শগ্রাম বহুমখী সমিতি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মোঃ রইছ মিয়া বলেন, দিঘির পাড়সহ এখানে ৬ একর ৬৯ শতাংশ ভূমি রয়েছে তাদের সমিতির জন্য। পুকুরের পানি রয়েছে ৫০০ শতাংশের মধ্যে। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি শুধু জানেন, পুকুরটি ছিল গৌরীপুরের জমিদারবাড়ির অধীনে।
নন্দীপুর গ্রামে চাঁদরায়ের দাসীবাড়ির ধ্বংশাবশেষ ও পাশে একটি পুকুর এখনো স্মৃতির স্মারক:
নন্দীপুর গ্রামে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শন দেখা যায়। এর মধ্যে অন্যতম দাসীবাড়ির ধ্বংশাবশেষ। প্রায় ২৮০ বছর আগে নির্মাণ করা দাসীবাড়ির ধ্বংশাবশেষ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশেই রয়েছে ইতিহাস বিজড়িত একটি দিঘি। যার নাম ‘দাসীবাড়ির দিঘি’। প্রায় শতবছর ধরে অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে থাকা ঐতিহাসিক এই দু’টি নিদর্শন হতে পারতো নন্দীপুরের সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন কেন্দ্র। চাঁদরায়ের সময়ে এই দাসীবাড়িতেই আনন্দ-কোলাহলে মুখরিত থাকতো। চাঁদরায়ের অবসর সময়ে তাকে সেবা দেওয়ার জন্য সুন্দর সুন্দর দাসীদের সমারোহে নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদ ও বিভিন্ন ভোজ আয়োজন হতো।
রাজকুমার সোনা রায় ও রণনায়ক চাদঁরায়ের মৃত্যু:
সে সময় চাঁদরায় যেভাবে দক্ষতার সাথে মোমেনসিং পরগনার নন্দীপুর বাসভবনকে উজ্জ্বল করতেছিলেন এবং জমিদারি কার্যক্রম সুন্দরভাবে চালাচ্ছিলেন তা ছিল তার অসাধারন সাফল্য। সেই সময় তার এক দারুণ দুর্ঘটনা ঘটে। তার একমাত্র পুত্র সোনা রায় (সোনা তলাপাত্র) শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সঙ্গে বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার অন্তর্গত কড়ই রাজবাড়িতে বাস করতেন। ওই বালক খুব সুদর্শন ছিলেন। এই সময় সোনা রায় ১৬ বছর বয়সে হঠাৎ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যু হয়। যথাসময়ে এই দুঃসংবাদ চাঁদরায়ের কাছে পাঠানো হয়। এই দুঃসংবাদ শুনে চাঁদরায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তার মেরুদণ্ড যেন ভেঙ্গে গেছে। শিশু সোনা রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি পত্নীবিয়োগের দুঃখ সয়েছিলেন, দ্বিতীয় বিয়ে পর্যন্ত করেননি। রামগোপালপুরের জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায় চৌধুরীর কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – ‘সেই জীবন সর্বস্ব অন্তিমের একমাত্র সম্বল পুত্র রত্নে বঞ্চিত হইয়া চাঁদরায় স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন। তাহার চক্ষে অশ্রু ঝরিল না, আর্তনাদ উঠিল না, কেবল অস্থি-চর্ম ভেদ করিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস বহিতে লাগিল। পুত্র শোকের সহিত পত্নী শোক নববেশ ধরিয়া দেখা দিল। শোকের দারুণ আবর্তে পড়িয়া তাহার কর্মময় জীবন ঘোর অবসাদ এবং নিরুৎসাহের গাঢ় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হইল। আর আশা উৎসাহ কিছুই রহিল না। স্বভাবসিদ্ধ ধৈর্যগুণে আত্ম-সংযমের চেষ্টা করিলেন বটে কিন্তু শান্তি, সুখ, আসক্তি কিছুই রহিল না। ইহার কিছুকাল পর চাঁদরায় ১৭৫৩ কিংবা ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে পিতৃ বর্তমানেই স্বর্গধামে গমন করেন।’
চাদঁরায়ের মৃত্যুর স্থান গৌরীপুরের বোকাইনগর বাসাবাড়ি অথবা নন্দীপুর বাসভবনে হতে পারে। শ্রৗকৃষ্ণের জীবদ্দশায়ই মোমেসিং পরগনায় জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ রায় এবং বগুড়ার কড়ই রাজবাড়িতে সোনা রায় মৃত্যুবরণ করেন। কড়ই রাজবাড়িতে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী ১৭৫৭/১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ
করেন।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পুত্র যুগলকিশোর রায় চৌধুরী:
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ রায় তার নাতনী সোনা রায়ের মৃত্যুর পর তরফ রায়চৌধুরীর অবশিষ্ট দুই পুত্র নিঃসন্তান থাকায় পলাশী যুদ্ধের পরে কৃষ্ণগোপাল দত্তক নিয়েছিলেন মাধবী তথা আলেয়ার গর্ভজাত সিরাজপুত্রকে। তখন দত্তক পুত্রের বয়স ছিল ছয় বছর। নবাব সিরাজের পুত্রের নয়া নামকরণ হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। কড়ই রাজবাড়িতে এভাবেই নতুন করে যাত্রা শুরু করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলারবংশ। পরবর্তী জমিদার যুগল কিশোর রায় চৌধুরীর আমলে মোমেনসিং পরগানার নাম থেকেই বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নামকরণ করা হয়। যেমন সেসময়ে কালেক্টর অব মোমেনসিং, ম্যাজিস্ট্রেট অব মোমেনসিং ইত্যাদি ইংরেজদের পদের নাম থেকে সহজে বোঝা যায় যে, ময়মনসিংহ জেলার নামকরণ সৃষ্টি হয়েছে মোমেনসিং পরগণা থেকে।
ঘোড়াঘাট পরগণায় সোনারায়ের স্মৃতিচিহ্নঃ
ঘোড়াঘাট পরগণায় শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী তার নাতির স্মৃতিকে অবিস্মরনীয় করে রাখার জন্য বগুড়ার একটি স্থানের নাম রাখা হয় সোনাতলা। বর্তমান সোনা রায়ের স্মৃতিচিহ্ন সোনাতলা উপজেলা। সোনা রায়ের ব্রাহ্মণ নাম সোনা তলাপাত্র। ঘোড়াঘাটে যে কয়েকটি বন্দর ছিল তার মধ্যে বালুয়া বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। সোনাতলার চেয়ে বালুয়া অতি প্রাচীন নাম। রেনেলের মানচিত্রে উল্লেখিত বালুয়া নামক স্থানের মাধ্যমে সোনাতলা নামের উৎপত্তির বয়সের সন্ধান পাওয়া যায়।