মোঃ আব্দুল আউয়াল।
শিক্ষক সমাজের সাম্প্রতিক ঐক্যবদ্ধ উত্থানকে কেবল ‘আন্দোলন’ নামে অভিহিত করা যথেষ্ট নয়; এটি হলো রাষ্ট্রের বিবেককে জাগ্রত করার এক মহৎ নৈতিক অভিযাত্রা। এ সংগ্রাম নিছক অর্থনৈতিক চাহিদার গতানুগতিক কোলাহল নয়, বরং দীর্ঘকাল ধরে পুঞ্জীভূত রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা এবং এক শ্রেণির আমলাতান্ত্রিক ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে আত্মমর্যাদার এক সমুচ্চ ঘোষণা।
প্রদত্ত সরকারি প্রজ্ঞাপনে (বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য সীমিত আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির ঘোষণা) যে প্রশাসনিক পদক্ষেপের প্রতিফলন ঘটেছে, তা এই নৈতিক শক্তির কাছে আমলাতন্ত্রের এক নিরুপায় নমনীয়তা ছাড়া আর কিছু নয়। বাহ্যত এটি একটি প্রশাসনিক বিজয় মনে হলেও, এটি মূলত প্রজ্ঞার শক্তির কাছে ক্ষমতা কাঠামোর এক দাপ্তরিক স্বীকারোক্তি।
শিক্ষক সমাজ এই জাগরণের মাধ্যমে যে গভীরতম সত্য উন্মোচন করেছেন, তা হলো: একটি জাতির প্রকৃত স্থিতিশীলতা ও উৎকর্ষ কোনো কাগুজে নীতিমালায় বা ক্ষমতা কাঠামোর নির্দেশে নিহিত নয়। বরং তা নির্ভর করে শিক্ষকের অটুট আত্মমর্যাদা, নৈতিক প্রাবল্য এবং তাঁদের পেশাগত সম্মানের সুরক্ষার ওপর।
আমেরিকার প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জন ডিউই যেমন বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রগতি নির্ভর করে আমাদের শিক্ষণ পদ্ধতির আধুনিকায়নের ওপর।
ঠিক তেমনিভাবে, বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজ তাঁদের এই সংগ্রামের মাধ্যমে কার্যত দেশের আগামীকালকে বাঁচানোর জন্য নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সম্মিলিত প্রয়াস কেবল অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়নি; এটি ছিল অবহেলা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শেকল ভেঙে সম্মান ও মর্যাদার এক দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ। এই নৈতিক প্রতিষ্ঠা, যা কোনো দাপ্তরিক আদেশ দ্বারা কেড়ে নেওয়া যায় না, সেটাই হলো শিক্ষকের সর্বোচ্চ আভিজাত্যপূর্ণ বিজয়।
অপরদিকে, প্রশাসনিক মহল কর্তৃক এই সীমিত সুবিধা প্রদানের ঘোষণাটি প্রমাণ করে যে, তারা শিক্ষক সমাজের নৈতিক চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এটি কোনো বদান্যতা বা সহৃদয়তা নয়, বরং এটি হলো বৃহত্তর সামাজিক অসন্তোষ এড়ানোর এক কৌশলী প্রত্যুত্তর। আমলাতন্ত্রের ঔদ্ধত্যের যে ভিত্তি দীর্ঘকাল ধরে মজবুত ছিল, এই জাগরণ সেই ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। ক্ষমতা কাঠামো উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়েছে যে, প্রজ্ঞার ধারককে অবদমিত রেখে কোনো জাতি তার আত্মিক উন্নতি নিশ্চিত করতে পারে না।
এই সমগ্র ঘটনাপ্রবাহের চূড়ান্ত বিশ্লেষণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়
, এই দ্বন্দ্বে শিক্ষক সমাজের নৈতিক জাগরণই পরম বিজয়ী। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে, যখন ন্যায়ের পক্ষে শিক্ষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হন, তখন এটি কেবল পেশাগত দাবি থাকে না, এটি রূপ নেয় অন্যায় ও অন্ধত্বকে পরাজিত করার এক মহৎ সামাজিক শক্তিতে।
এই পদক্ষেপ কেবল সীমিত আর্থিক অর্জনের সোপান নয়; এটি একটি জাতিকে তার জাতীয় বিবেককে প্রশ্ন করার আহ্বান জানায়। এটি এক নতুন, মানবিক ও ন্যায্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা—যেখানে শিক্ষকের সম্মান রাষ্ট্রের নৈতিকতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচিত হবে। এটাই হলো প্রকৃত অর্থে এক আভিজাত্যপূর্ণ মীমাংসা।
-লেখক, অধ্যক্ষ, ছাতিয়ানতলা গার্লস স্কুল এন্ড ইউনাইটেড কলেজ।