রাজধানীর গুলশানে সাবেক এক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আবদুর রাজ্জাক ওরফে রিয়াদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে একটি নতুন পাকা ভবন তৈরি হচ্ছে, যা নিয়ে এলাকায় ব্যাপক আলোচনা চলছে। প্রথম আলোর বরাত দিয়ে জানা গেছে, প্রায় আড়াই মাস আগে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে এবং গত সপ্তাহে এর ছাদ ঢালাই দেওয়া হয়েছে।
আজ রোববার (২৭ জুলাই, ২০২৫) দুপুরে সেনবাগ উপজেলার নবীপুরে প্রথম আলোর সাংবাদিক সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পান, একতলা একটি চার কক্ষবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আবদুর রাজ্জাক বর্তমানে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। গত শনিবার রাতে গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসা থেকে রিয়াদসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনায় গুলশান থানায় করা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিয়াদসহ চারজনকে আদালত সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন।
এসময় ওই সাংবাদিক রিয়াদের গ্রামে গিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, আর্থিক অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা একজন ছাত্রের বাড়িতে হঠাৎ করে পাকা ভবন নির্মাণ হওয়ায় এলাকায় নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে রিয়াদের গ্রেপ্তারের ঘটনা এই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে পরিবারের দাবি, জমানো টাকা, অনুদান ও ঋণ নিয়ে এই ভবনটি তৈরি করা হচ্ছে।
রিয়াদদের নির্মাণাধীন ভবনের পাশেই চাচা জসিম উদ্দিনের জীর্ণ টিনের ঘর। জসিম উদ্দিন জানান, আড়াই মাস আগে রিয়াদ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। আগে সেখানে একটি ভাঙাচোরা টিনের ঘর ছিল। রিয়াদের মা-বাবা এখন বাড়ির প্রবেশপথের পাশের একটি কক্ষ ভাড়া করে থাকেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিয়াদের এক চাচি সাংবাদিককে জানান, রিয়াদের বাবা ও বড় ভাই দুজনেই রিকশা চালাতেন, যদিও এখন আর চালান না। রিয়াদ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন এবং গত ৫ আগস্টের পর সমন্বয়ক হয়েছেন। তিনি মাঝে মাঝে বাড়িতে আসেন।
রিয়াদের মা রেজিয়া বেগম জানান, তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছোট ছেলে রিয়াদ ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। বড় ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, যদিও রেজিয়া বেগম এও বলেন যে বড় ছেলে ফুটপাতে ব্যবসা করেন। তিনি আরও জানান, দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
রেজিয়া বেগম বলেন, মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে, স্বামীর আয়ের টাকায় ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন। রিয়াদ নিজেও টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ জোগান। পাকা ভবনটি ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে, স্বামীর জমানো টাকা এবং ধারদেনা করে নির্মাণ করছেন। গত বছরের বন্যায় তাদের ঘর সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং বন্যার পর সরকারের কাছ থেকে পাওয়া চার বান্ডিল ঢেউটিন বিক্রি করেছেন। এছাড়াও, আল-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন, যা ঘরের কাজে ব্যয় করেছেন। তবে রেজিয়া বেগম ব্র্যাক থেকে ঋণ নেওয়ার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, রিয়াদের টাকাতেই পাকা ভবন হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রেজিয়া বেগম এই দাবি অস্বীকার করে বলেন, রিয়াদ কোথা থেকে টাকা দেবে? তাকে উল্টো প্রতি মাসে টাকা দিতে হয়। তিনি টিউশনি করেন এবং আত্মীয়স্বজন তাকে সহযোগিতা করে। রিয়াদের টাকায় বাড়িতে ভবন নির্মাণের কথা সঠিক নয়।
স্থানীয় বাসিন্দা জোবায়ের হোসেন জানান, তিনি তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, রিয়াদ ঢাকার প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ছাত্র। রিয়াদের সহপাঠী কোরবান আলী ওরফে হৃদয় বলেন, তিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রিয়াদের সঙ্গে পড়েছেন। পরে এইচএসসি পাস করে সে ঢাকায় ভর্তি হয়েছে এবং সেখানে রাজনীতি করত। গত ৫ আগস্টের পর সে সমন্বয়ক হয়েছে বলে শুনেছেন। তবে এলাকায় সমন্বয়ক পরিচয়ে কোনো দাপট দেখাত না বলে জানান কোরবান।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উদ্যোগে কয়েক মাস আগে ছাত্রসংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। রিয়াদ বর্তমানে এই ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এই সংগঠন হওয়ার আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গত ফেব্রুয়ারিতে সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছিল, সেই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছিল রিয়াদকে।
গত শনিবার রাতে রিয়াদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহিম হোসেন (মুন্না) এবং সদস্য মো. সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাবও গ্রেপ্তার হন। এ ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে, রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সারা দেশের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।