গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু)-এর চতুর্থ নির্বাচনের এক মাস পার হয়েছে। কিন্তু এখনো সংসদের নামে কোনো আলাদা তহবিল গঠন হয়নি, খোলা হয়নি ব্যাংক হিসাবও। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি সেমিস্টারে গকসুর নামে ২০০ টাকা করে ফি নেওয়া হলেও সেই টাকা সংসদের হাতে আসে না, জমা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বাজেটেই।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী থেকে প্রতি সেমিস্টারে ২০০ টাকা করে গকসু ফি আদায় করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিয়ম অনুযায়ী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ব্যাংক হিসাব থাকতে পারে না। সেই নিয়মেই এই অর্থ জমা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল হিসাবেই।
প্রশাসনের দাবি, ‘ছাত্র সংসদ ফি’-এর সব খরচের হিসাব সংরক্ষিত থাকে, কোন সেশনে কত টাকা উঠেছে, কোথায় ব্যয় হয়েছে, সবই বাজেটে উল্লেখ থাকে।তবে বাস্তবে সেই বাজেটে গকসুর কোনো স্বাধীনতা নেই। সংসদের নামে নেওয়া টাকায় তারা সরাসরি কোনো খরচ করতে পারেনি এখনো। গকসু কার্যালয়ের কাগজ-কলম থেকে অফিসের সরঞ্জাম কেনা কিংবা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলেও প্রশাসনের অনুমোদন ও বাজেট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে।
গকসুর সহসভাপতি ইয়াসিন মৃদুল দেওয়ান বলেন, “নির্বাচিত হয়ে শপথ নেওয়ার পরপরই প্রশাসনের উচিত ছিল সংসদের সব দায়িত্ব ও তহবিল বুঝিয়ে দেওয়া। কিন্তু প্রশাসন তা করেতে পারেনি। আমরা তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। দীর্ঘ সাত বছরের হিসেব সংরক্ষিত রয়েছে এবং প্রশাসন দ্রুত তা বুঝিয়ে দিতে ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “গকসুর নিজেস্ব ব্যাংক হিসেব ও নির্দিষ্ট বাজেটের খসড়া প্রদানের কাজ মোটামুটি শেষ দিকে। ছাত্র সংসদের সতন্ত্র তহবিল হলে কার্যক্রম দ্রুত সময়ের মধ্যে করা সম্ভব হবে। বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে না।”
গকসুর নবনির্বাচিত কোষাধ্যক্ষ খন্দকার আব্দুর রহিম বলেন, “গকসুর নিজস্ব একাউন্ট চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রশাসনের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকাউন্ট থেকেই ব্যয় পরিচালিত হচ্ছে। তবে নিজস্ব হিসাব খোলার কাজ প্রায় শেষের দিকে।”
তিনি বলেন, “বর্তমান অবস্থায় আর্থিক স্বাধীনতা খুব সীমিত। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে গকসু যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়, সেখানে বাধা আসছে। তহবিল গঠন ও নিজস্ব ব্যাংক হিসাব সচল হলে স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতা দুটোই নিশ্চিত হবে।”
গকসুর সংস্কৃতি সম্পাদক মো. মারুফ বলেন, “নিজস্ব তহবিল না থাকায় আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-কারিকুলাম অ্যাকাউন্ট থেকেই সাংস্কৃতিক আয়োজনে ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। এতে স্বাধীনভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।”
তিনি জানান, সাম্প্রতিক ‘লালন স্মরণোৎসব’-এর আয়োজনের সময় প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল অর্থসংকট। “বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট থেকে খুব সীমিত অর্থের অনুমতি মেলে, ফলে অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি,” বলেন মারুফ।
মারুফ আরও বলেন, “গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিসর এখনো নাজুক। অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণব্যবস্থা না থাকায় টেকসই সাংস্কৃতিক বিকাশে বাধা তৈরি হচ্ছে। নিজস্ব তহবিল সচল হলে এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব।”
গকসুর সমাজকল্যাণ ও ক্যান্টিন সম্পাদক মনোয়ার হোসেন অন্তর বলেন, “আমরা শুরুতে ক্যান্টিনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অভিযান চালিয়ে অনেক পরিবর্তন এনেছি। রান্নাঘর পরিষ্কার রাখা, খাবার ঢেকে রাখা, কর্মীদের হাইজিন মানা—এসব এখন অনেকটাই উন্নত।”
তিনি জানান, “শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও কল্যাণই আমাদের মূল লক্ষ্য। প্রশাসনও এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে।”
নির্বাচনের পর মাত্র এক মাসেই গকসু আয়োজন করেছে তিনটি কার্যক্রম। এর মধ্যে ‘এশিয়া কাপ কোয়ালিফায়ারে বাংলাদেশ বনাম হংকং ফুটবল ম্যাচ প্রদর্শন’, ‘লালন স্মরণোৎসব’ সাংস্কৃতিক আয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে অভিযান পরিচালনা।
ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস অনুষদের শিক্ষার্থী মো. মেজবান নবী সিফাত বলেন, “আমরা প্রতি সেমিস্টারে গকসুর নামে ২০০ টাকা দিই, কিন্তু সংসদের তহবিলই যদি না থাকে, তাহলে এই টাকা কার কাছে যায়? গকসু যদি প্রশাসনের বাজেটের দয়ায় চলে, তাহলে তার অস্তিত্বই বা কোথায়?”
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে না। তাই ছাত্র সংসদের ফি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল একাউন্টেই জমা রাখা হয়।”
তিনি জানান, গকসুর জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে।তবে এই টাকা কোথায় ও কীভাবে ব্যয় হয়, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি কোষাধ্যক্ষ।
তিনি বলেন, “প্রতি বছরের জন্য আলাদা বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাজেট দেখে বিস্তারিত বলা যাবে; বর্তমানে আমার কাছে এর নির্দিষ্ট তথ্য নেই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন বলেন, “ইউজিসির নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হিসাবই থাকবে। ৭ বছর ধরে যে ছাত্র সংসদ ফি নেওয়া হয়েছে, তা সেই ফান্ডেই আছে। গকসুর জন্য নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হবে এবং সংসদকে দুই বছরের জন্য বাজেট দেওয়া হবে।”