নিজস্ব প্রতিবেদক।।

যার কাছে বিশাল স্নেহ, শাসন ও ভালোবাসায় বটবৃক্ষের ছায়া পেয়েছিলো ছোট ছোট কোমলমতি স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা, তিনি হচ্ছেন অকাল প্রয়াত শিক্ষক সমর সেন।  

শিক্ষার্থীদের একজন প্রিয় শিক্ষক সমর সেন যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেল বাড়িয়া গ্রামের মৃত শিক্ষক  হরিপদ সেনের কনিষ্ঠ পুত্র।  

১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি  শিক্ষক  হরিপদ সেন দম্পতির ঘর আলোকিত করে জন্ম নেন সমর সেন। সেন পরিবারের ৪ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন সমর সেন।

স্থানীয় নারিকেল বাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে এসএসসি  পাশ করে যশোর সরকারী মাইকেল মধুসূদন কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন । একই কলেজ থেকে পরবর্তীতে ২০০০ সালে জাতিয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধাতালিকায় ৮ম স্থান পেয়ে  বাংলায় মাস্টার্স পাশ করেন সমর সেন।

এর পরে ২০০৩ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি। তাঁর কর্মস্থল ছিলো বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেল বাড়িয়া ইউনিয়নের ক্ষেত্রপালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখান থেকে তিনি  নিকটবর্তী খানপুর সরকারি প্রাথমিকে কিছুদিন খন্ডকালীন দায়িত্বপালন করেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন বোর্ড, ময়মনসিংহ থেকে সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। এর আগে তিনি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীন জাতীয় বহুভাষা সাটলিপি প্রশিক্ষন ও গবেষনা একাডেমী(নট্রামস) বগুড়া থেকে A+ পেয়ে সার্টিফিকেট লাভ করেন। এছাড়াও ২০০৯ সালে বাংলাদেশ টেকনিকাল শিক্ষা বোর্ড, ডাকা থেকে কম্পিউটার এ্যাপ্লিকেশনে A+ পেয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করেন তিনি।

প্রতিভাবান সমর সেন ২০১১ সালে   আইসিটিতে খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে বাঘারপাড়া উপজেলা  মাস্টার ট্রেইনার নিযুক্ত হন। একসময়য় তিনি নিজ গ্রামের বুলবুল ইসলাম কে সাথে নিয়ে নারিকেল বাড়িয়া বাজারে গড়ে তলেন দীপন মাল্টিমিডিয়া নামে একটি বহুমুখি আইটি প্রতিষ্ঠান। সমর সেন চলে গেলেও আজও দিপন মাল্টিমিডিয়া এলাকার ছেলে মেয়েদের কম্পিউটার প্রশিক্ষনসহ নানাবিধ বিষয়ে শিক্ষালাভ করছেন।  

ধূলাময়, মায়াময় এই পৃথিবীতে অগণিত মানুষের জন্ম মৃত্যুর এই ধারাবাহিকতা চিরন্তন। জীবননাট্যের মঞ্চে এই যে রঙ্গলীলা অব্যাহত ধারায় চলছে, তার গুঢ় খবর কেউ জানেনা। মৃত্যুই এর চিরন্তন সত্য। জন্মের সঙ্গেই মৃত্যু চির সাথী হয়ে আছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে মানুষ মরনশীল । আর বিশ্ব মানবতার মুক্তির মহাসনদ মহাগ্রন্থ আল  কোরআনে বলা হয়েছে-‘কুল্লু নাফছিন যাইকাতুল মউত’। অর্থাৎ প্রত্যেক জীবকে মৃত্যুর শরাব পান করতেই হবে। তবে কোন কোন মুত্যৃ আমাদের অন্তরে দাগ কাটে, আমাদের কাঁদায়, আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়, কেউ কেউ কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যাই বা শোকে অধিক কাতর হয়। এমনই একটি মৃত্যু ঘটেছিল ২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ।  স্নায়ুতন্ত্রে সংক্রমনের পরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি পরলোকগমন করেন।   

বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেল বাড়িয়া ইউনিয়নের ক্ষেত্রপালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাংলা  শিক্ষক সমর সেন। তিনি দুনিয়ার সমস্ত মায়া ত্যাগ করে তার দেশে-বিদেশে অসংখ্য অগণিত ছাত্রছাত্রী, আত্মীয়-স্বজন গুণগ্রাহী রেখে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মওলার সান্নিধ্যে চলে গিয়েছিলেন (ইন্না….রাজিউন)।

প্রয়াত শিক্ষক  সমর সেনের বহু গুণ ছিল। কখনো তিনি কঠোর শিক্ষক, কখনো স্নেহপূর্ণ পিতা, কখনো বন্ধু ছিলেন। একজন মানুষের মৃত্যুর মাঝেই সব কিছু শেষ হয়ে যায় না, বরং শুরু হয় জ্বলজ্বলে ইতিহাস হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নতুন উদ্দীপনা দেওয়া। আজও তিনি শুধু তার ছাত্র না, তাদের মতো আরও অনেকের মনেই চিরদিনের জন্য থেকে গেছেন।

সমর সেনের সহকর্মী বন্ধু শিক্ষক কায়কোবাদ হসেন বলেন, আমরা একজন আদর্শ শিক্ষককে হারাইনি একজন দায়িত্ববান ও প্রতিভাবান মানুষকে হারিয়েছি। তিনি আমাদের সার্বিক দিক দিয়ে উৎসাহিত করতেন।সুশিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হলে আদর্শ শিক্ষকের কোন বিকল্প নেই। যিনি নিজেই ফুল ফুটান এবং সৌরভ বিতরণ করেন, তাদের মধ্য থেকে ক্ষণজন্মা শিক্ষক  সমর সেন ।    

সমর সেনের এক ছাত্র জানান,  উনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ প্রতিভার অধিকারী। আমরা সবাই উনাকে ভয় পেতাম। যা স্বাভাবিক ভাবেই একজন নতুন ছাত্র হিসেবে হয়ে থাকে। স্কুলে ক্লাস শুরুর আগে দৈনিক সমাবেশ হতো। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী সমাবেশে উপস্থিত হয়েছে কিনা তা তিনি নিশ্চিত করতেন। আমাদের সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার জন্যে উৎসাহিত করতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য বলতেন। শারীরিক ফিটনেসের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতেন।

স্যারের জন্য আমরা কিছুটা ভয়ে থাকতাম। কিন্তু যখনেই উনি ক্লাস শুরু করতেন আমাদের ভয় কেটে যেত।তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন।তিনি প্রতিটি পার্টকে সহজলভ্য করে তুলতেন।একজন প্রকৃত শিক্ষকের কাজ শুধু ক্লাসে পড়া দেওয়া আর তা ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা নয়। পাঠ্যপুস্তক বা পড়াটাকে উপভোগ্য করে তোলা এবং ছাত্র ছাত্রীদের পড়তে বাধ্য করা।।স্যার তাই করতেন। আমাদের ক্লাসে পড়া বুঝিয়ে দেয়ার পাশাপাশি আমাদের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক খোঁজ খবর নিতেন।

স্যারের অবসর জীবনে যখনেই দেখা হতো তিনটি বিষয়ে ভালো করে জ্ঞান অর্জন করতে বলতেন— তোমাদের অবশ্যই নিয়ম জানতে হবে, দেশের সকল বিষয়ে জানতে হবে, নিয়ম মেনে পড়া-লেখা করতে হবে তবেই তুমি মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে। এখনও চোখে ভেসে উঠছে স্যারের কথা গুলি বলার দৃশ্যপট। তিনি গরীব ও মেধাবী ছাত্র- ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। এ বিদ্যাপীঠে নিয়ম শৃঙ্খলার অনুসরণ ও আদর্শ জীবন প্রণালী গঠনে তার জুড়ি নেই। অভিভাবকদের মধ্যেও তিনি সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব।