।। লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল।।
অনিল হাজারিকার জন্ম বাংলা ১৩৬২ সনের ২০ শে পৌষ বুধবার মাগুরা জেলার ধনেশ্বরগাতী ইউনিয়নের তিলখড়ি গ্রামে। পিতা হাজারিলাল বিশ্বাস, মাতা যশোদা রাণী বিশ্বাস। ৫ ভাই বোনের মধ্যে অনিল হাজারিকা বড়। তিলখড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু। পরবর্তীতে সিংড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে দারিদ্রতার কারণে স্কুলের গন্ডী পার হতে পারেননি। ফলে পারিবারিকভাবে তিনি গানের জগতে প্রবেশ করেন। পিতা হাজারিলাল একজন কীর্তনীয়া , লোক সংগীত, ভাটিয়ালী গানে পারদর্শী ও সঙ্গীত প্রেমী ছিলেন। মা যশোদা দেবীও সংগীত ভক্ত ছিলেন। মনে হয় বাবা মার সন্তান হিসাবে অনিল হাজারিকার রক্ত সম্পর্কিত কারনে সঙ্গীতের প্রতিভা লাভ করেছেন।
বাবার কাছেই সংগীতে প্রথম হাতেখড়ি। সংগীত গুরু হিসাবে সিংড়ার কার্তিক অধিকারী ,অনিল বিশ্বাস,বিমল কুমার রায়,গৌর পদ বিশ্বাস, বিমল কুমার রায়ের কাছে তিনি নজরুল সঙ্গীতের তালিম নেন। ঝিনাইদহের ওস্তাদ অমরেশ বিশ্বাস ও তার সহধর্মিনী সাধনা বিশ্বাসের নিকট তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি যশোরের মাইকেল সঙ্গীত একাডেমিতে রণজিৎ দেবনাথ ও ওস্তাদ মোশারফ হোসেনের নিকট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নেন।
অনিল হাজারিকা মুলত লোক সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি একজন স্বভাব কবিও বটে। তিনি নিজেই গান
বাঁধেন ও সুর করেন। তার প্রতিভার বিকাশও হয়েছে নানা ভাবে। সঙ্গীত চর্চা করতে করতেই তিনি সঙ্গীত রচনা আরম্ভ করেন। তদসঙ্গে সুরারোপ করতেও শুরু করেন। শিল্পী অনিল হাজারিকা এ্যাট্রোলজিও জানেন। তিনি বাংলাদেশ এ্যাট্রোলজি সোসাইটির আজীবন সদস্য।
অনিল হাজারিকা ১৯৮৫ সালে খুলনা বেতারে কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী হিসাবে তালিকাভ’ক্ত হন। অনিল হাজারিকা বৃহত্তর যশোরের ভাষায় যশোরের আঞ্চলিক গানের অডিও ক্যাসেট করেছেন। তারমধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছে, ‘আম গাছে ঢেলা মারে কিডারে’, ঠিলে ধুয়ে দে বউ গাছ কাটতি যাব’, দৈনিক হাটবারে দাদী কাঁঠাল আনতি কয়,আমাগের উনি গেছে কনে,’ ইত্যাদি আরও অসংখ্য গান। তিনি ১২ শতাধিক বিভিন্ন গান রচনা করেছেন। তার ব্যক্তিগত বাদক হিসাবে (তবলচি) একই গ্রামের সঞ্জিত মন্ডল ছোটবেলা থেকেই তার সাথে থাকেন। তার সহযোগীতায় রয়েছেন কার্তিক বিশ্বাসও।
তার প্রথম স্ত্রী জোৎস্না হাজারিকা নিসন্তান হওয়ায় নিজেই ঘটকালি করে সঙ্গে বরযাত্রী হয়ে মাসিমার মেয়ে পুষ্প হাজারিকাকে দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে ঘরে এনেছেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে দোলন ও ফুলন নামের দুই মেয়ে। দোলন সিংড়া কলেজের এইচএসসির ২য় বর্ষের ছাত্রী। ফুলন সিংড়া হাই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। দুটি মেয়েই প্রতিভাময়ী ও সঙ্গীত প্রিয়। তারা গানের তালে তালে নৃত্য করে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
অনিল হাজারিকা ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে গুনি শিল্পী হিসাবে সম্বর্ধিত হয়েছেন ও পুরস্কৃত হয়েছেন। যশোরের নৃত্যবিতান গুনি শিল্পী হিসাবে তাকে সম্বর্ধিত ও পুরস্কৃত করেছেন। বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী দক্ষিন বাংলার এই জনপ্রিয় লোক সঙ্গীত শিল্পীকে ২০১৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ফোকলোর গবেষনা কেন্দ্র ঐতিহ্য গুনীজন সম্মাননা প্রদান করেন। বর্তমানে লোক সঙ্গীত শিল্পী অনিল হাজারিকা প্যারালাইজড আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় নিজ বাড়িতে বিছানায় ভুগছেন।
২০১২ সালের ৯,১০ও ১১ই মার্চ খাজুরা এম এন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে “গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র“আয়োজিত ৩ দিন ব্যাপী গ্রামীন জীবনযাত্রা ও কৃষি প্রযুক্তি তথ্য,বীজ মেলার অনুষ্ঠান করে। এই অনুষ্ঠানে দেশের ৩০ জন গুনীজনের সম্মাননা প্রদান করা হয়।ওই সময় জীবদ্দশায় গুনীজন সম্মাননার মধ্যে যশোরের আঞ্চলিক গানের স্রষ্টা অনিল হাজারিকা ছিলেন অন্যতম একজন । স্রষ্টা অনিল হাজারিকার প্রায় ১২ শতাধিক গানের অধিকাংশই জনপ্রিয় তবু অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় নিজ বাড়িতেই ভুগছেন।