বিলাল হোসেন মাহিনী।
মানুষ সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ মানুষকে হাজারও নেয়ামত দান করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান নেয়ামত হলো মনের ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে ভাষাজ্ঞান। সে হিসাবে, মাতৃভাষা মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত। ভাষা সর্ম্পকে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, ‘দয়াময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষ। শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা’ (সুরা আর-রহমান)। মহান আল্লাহ-ই ভাষার ¯্রষ্টা। ভাষার ব্যাপারে মাখলুক তথা সৃষ্টির কোন প্রকার ভুমিকা নেই। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘তার আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভুমন্ডল সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে’ (সুরা রুম- ২২)। এখানে ভাষা বলতে নিদিষ্ট কোনো ভাষার কথা বলেন নি তিনি। সব ভাষাই আল্লাহর নির্দশন। সে হিসাবে সব ভাষার মর্যাদা সমান। বিশ্বনবী (সাঃ) বলেন, ‘তিন কারণে আমি আরবি ভাষাকে ভালোবাসি। এক. আমি আরবি ভাষী, দুই. আল-কুরআনের ভাষা আরবি এবং তিন. জান্নাতের ভাষা হবে আরবি’।
আমরা বাংলায় কথা বলি। আল-কুরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, হাদিসের ব্যাখাসহ বিভিন্ন কিতাবাদি, বইপত্র বাংলা ভাষায় অধ্যায়ন করি। ভাষা সর্ম্পকে আল্লাহ আরও বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে স্বজাতির ভাষাভাষি করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিস্কার ভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। অতঃপর আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন যাকে চান এবং পথ দেখান যাকে চান, তিনি মহা সম্মানিত, প্রজ্ঞাময়’ । মহান আল্লাহ আরও ঘোষনা করেন, ‘আমি আপনাকে সত্যসহ প্রেরন করেছি সুসংবাদদাতা ও সর্তককারী হিসাবে। এমন কোন সম্প্রদায় নেই যাদের কাছে সর্তককারী প্রেরিত হয়নি’ (সুরা ফাতির)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর মহা অনুগ্রহ হয়েছে মুমিনদের উপর, তাদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একজন রাসুল প্রেরন করেছেন। যিনি তাদের ওপর তার আয়াত সমুহ পাঠ করেন এবং তাদের পবিত্র করেন। আর তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশচয় আগে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে ছিল’ (সুরা আল ইমরান)।
ভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। পৃথিবীতে হাজার হাজার ভাষা রয়েছে। ভাষা সমুহের মধ্যে বাংলা ভাষা একটি অন্যতম ভাষা। সারা পৃথিবীতে প্রায় পচিঁশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এটি, একটি প্রাচীন ভাষা। তাছাড়া আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষা। বাংলা নিয়ে আমরা গর্বিত। জাতিগত ভাবে সফলতা অর্জন করতে হলে, সর্ব প্রথম মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো জাতির মাতৃভাষা যতক্ষন পর্যন্ত সাহিত্য সংস্কৃতির স্বাক্ষর হবে না, ততোক্ষন পর্যন্ত সে জাতি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না।
মহান আল্লাহ’র সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘আশরাফুল মখলুকাত’ হলো মানুষ। মানুষ ভাষা দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে এবং একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। মানুষের পরিচয় বা সংজ্ঞায় আরবিতে বলা হয়, ‘হায়ওয়ানুন নাতিক’, অর্থাৎ ‘বাক্শক্তিসম্পন্ন প্রাণী’।
ভাষা বা বর্ণে নয়, কর্মেই পরিচয় ঃ
আমরা মানুষ একই পিতা-মাতা তথা আদম-হাওয়া (আঃ)-এর সন্তান। সাদা-কালো, লম্বা-খাটো সে তো আল্লাহর সৃষ্টি। বর্ণবৈষম্য, ভাষাবৈষম্য এবং ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন: ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন। (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)। বিদায় হজের ভাষণে নবি করিম (সাঃ) বলেছেন: ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (সহিহ বুখারি) সুতরাং কোনো ভাষাকে হেয়জ্ঞান করার অবকাশ নেই, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই ও অবহেলা করার অধিকার নেই। কেননা, ভাষার স্রষ্টা মহান আল্লাহ। তাঁর সৃষ্টির অবমূল্যায়ন করা তাঁর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর।
ভাষাচর্চা ইবাদত। আরবি ভাষার ব্যাকরণ মুসলমানদের হাতেই রচিত হয়। অনারবদের কুারআন পড়তে সমস্যা হতো বিধায় হযরত আলী (রাঃ) তাঁর প্রিয় শাগরেদ হযরত আবুল আসওয়াদ দুওয়াইলি (রাঃ)-কে নির্দেশনা দিয়ে আরবি ভাষাশাস্ত্র প্রণয়ন করান, যা ইলমে নাহু ও ইলমে ছরফ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে উচ্চতর ভাষাতত্ত্ব ইলমে বায়ান, ইলমে মাআনি ও ইলমে বাদির উন্নয়ন ঘটে; যার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইমাম আবদুল কাহির জুরজানি (রঃ) ও ইমাম জামাখশারি (রঃ)। সাহিত্যচর্চাও ইবাদত : সুসাহিত্য রচনাও ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন: ‘হে নবী (সা.), আমি আপনার প্রতি সর্ব সুন্দর কাহিনি বর্ণনা করেছি।’ (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ২) প্রিয় নরি (সাঃ) নিজে কাব্য করতেন। বিখ্যাত সাহাবি হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) কাব্য রচনা করতেন। হযরত আয়িশা (রাঃ) কাব্যচর্চা করতেন। এভাবে ইসলামের সব যুগেই বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্যচর্চা চলে আসছে।
আসুন ভাষার বিকৃতি নয়, বরং বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিতে অনুবাদ, সৃজনশীল লেখনীর মাধ্যমে ভাষা ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করি। ভাষার ব্যবহার ইবাদত হিসেবে মহান আল্লাহ যেনো কবুল করেন। আমিন।