গত ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া। হামাসের একটি বিবৃতিতেই ঘটনাটির কথা প্রকাশ্যে আসে। ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডও পরে হানিয়ার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে।
হামাস এবং ইরান সেনার বিবৃতিতে দাবি করা হয়, জিয়োনিস্টরা হানিয়ার বাড়িতে ঢুকে হামলা চালিয়েছে। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই তেহরান গিয়েছিলেন হানিয়া। এরপরেই বিশ্ব জুড়ে হইচই পড়ে।
এরপর দাবি ওঠে, হানিয়াকে হত্যা করা হয়েছে রিমোট কন্ট্রোল বোমার সাহায্যে। তাকে হত্যা করতে নাকি অন্তত দু’মাস আগে ইরানের রাজধানী তেহরানের সেই গেস্ট হাউসে দূর নিয়ন্ত্রক বোমা বসিয়েছিল ইসরাইলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। ইরানের সেনাবাহিনী এলিট রেভলিউশনারি গার্ডের কয়েকজন কর্মকর্তার সূত্র উদ্ধৃত করে এ খবর জানিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস।
পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মঙ্গলবার তেহরানে গিয়ে গেস্ট হাউসের যে অংশে হানিয়া ছিলেন, সেখানেই বসানো হয়েছিল বোমাটি। গভীর রাতে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ইরান প্রশাসনের মধ্যে ইসরাইলি গুপ্তচর সংস্থার জাল কতটা বিস্তৃত, হানিয়া হত্যার ঘটনা তারই প্রমাণ বলে মার্কিন গণমাধ্যমটির দাবি।
‘রেভলিউশনারি গার্ড’ বাহিনীর দু’জন কর্মকর্তা জানানয়ে, ২০২০ সালে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাকরিহজাদেহকে নিখুঁতভাবে রিমোট কন্ট্রোল মেশিনগানের সাহায্যে হত্যা করেছিল মোসাদ। একই পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছেন হানিয়াও। তবে রিমোট কন্ট্রোল মেশিনগানের বদলে তাকে হত্যা করা হয়েছে রিমোট কন্ট্রোল বোমার সাহায্যে।
ইরান এই হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করে প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করেছে। এরপরেই প্রশ্ন উঠতে থাকে, রিমোট কন্ট্রোল বোমাটি ওই গেস্ট হাউসে রেখেছিল কারা? যখন এই প্রশ্ন ঘিরে সারাবিশ্বে কৌতূহল, তখন তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের দৌলতে প্রকাশ্যে আসে একটি নাম- অমিত নাকেশ। নাম শুনেই বোঝা যায় এই লোক ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
তুরস্কের সংবাদমাধ্যমগুলোও তেমনই দাবি করেছিল। তাদের দাবি, অমিত ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ইসরাইলি, যিনি কাজ করেন ইসরাইলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হয়ে। তুরস্কের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়, হানিয়াকে হত্যা করতে অমিতকে কাজে লাগিয়েছিল ইসরাইল।
ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখন তুর্কি সংবাদমাধ্যম ‘আকদেনিজ গেরেক গেজেটেসি’, ‘গুনেইডোগু এক্সপ্রেস’ এবং ‘হ্যাবার গ্লোবাল’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, মোসাদের নির্দেশে তিনিই গিয়ে উত্তর তেহরানের ওই গেস্ট হাউসে বোমা লাগিয়ে এসেছিলেন, যেখানে হানিয়া থাকছিলেন।
তুরস্কের নিউজ-ভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘উসাক ওলে’ তো ধারণার ওপর ভিত্তি করে অমিতকে নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদনও ছেপে ফেলেছিল। সেখানে লেখা ছিল, হানিয়ার ‘আততায়ী’র নাম অমিত হওয়ার কারণে স্পষ্ট যে তিনি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইসরাইলি।
তুরস্কের দেখাদেখি আরো বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, হানিয়া হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিলেন অমিতই। এই নিয়ে যখন হইচইয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেতেই প্রকাশ্যে আসে সত্য। আসলে অমিত নাকেশ নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্বই নেই। ভাষার আবর্তে পড়ে মস্ত বড় ভুল করে বসেছেন তারা। আসলে ‘অমিত নাকেশ’ শব্দটি হিব্রু শব্দ ‘হ্যামিটনাকেশ’-এর অনুরূপ শোনায়। হিব্রুতে ‘হ্যামিটনাকেশ’-এর অর্থ হত্যাকারী। হানিয়া হত্যার পরেই ইনস্টাগ্রামে বেশ কয়েকটি পোস্ট ভাইরাল হয়। যেখানে হানিয়াকে হত্যার জন্য ‘হ্যামিটনাকেশ’কে ধন্যবাদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কালেচক্রে ‘হ্যামিটনাকেশ’ হয়ে যায় ‘অমিত নাকেশ’।
‘অমিত নাকেশ’-এর একটি অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই সব জালে পড়েই একটি কাল্পনিক চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তুরস্কের সংবাদমাধ্যমগুলো।
‘টাইমস অফ ইসরাইল’ এবং ‘জেরুসালেম পোস্ট’ বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে এনে সত্য প্রকাশ করে। পরে প্রতিবেদনের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমগুলো।
হামাস প্রধানকে হত্যার জন্য ইসরাইলকে দোষারোপ করলেও তেল আবিব এখনো এই অভিযোগ সম্পর্কে নীরব। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, নিজেদের দিকে সাময়িক দৃষ্টি ঘোরাতে ইচ্ছা করেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘অমিত নাকেশ’-এর জাল ফেলে ইসরাইল। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা/ নয়া দিগন্ত থেকে নেয়া