।। লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল।।
যাঁদের অবদানে সারাদেশে শিক্ষাবিস্তার লাভ করেছে তাদের মধ্যে অনন্য এক নাম কাজী আব্দুল হালিম। কাজী আব্দুল হালিম জন্মেছিলেন ১৯২০ সালে কালীগঞ্জ থানার গোমরাইল গ্রামে তার মাতুলালয়ে। তার পৈত্রিক আবাস বাঘারপাড়ার মির্জাপুর গ্রামে। শৈশব কেটেছে নিজ গ্রাম মির্জাপুরে। পিতা কাজী আব্দুল মালেক ছিলেন একজন কাস্টম ইন্সপেক্টর। তার কর্মস্থল ছিলো ভারতের পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কলিকাতায়। কাজী আব্দুল মালেক ছিলেন একজন সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন জ্ঞানতাপস ড. মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ ‘র অত্যন্ত স্নেহধন্য ছাত্র। ড. মোহম্মদ শহীদুল্লার চিন্তা-চেতনা তাঁর জীবনকে বিরাট ভাবে প্রভাবিত করেছিলো। তাঁর প্রতিটি চিন্তায় কাজে তিনি শিক্ষাগুরু ড. শহীদুল্লাহ’র দর্শনকে কঠোরভাবে মেনে চলতেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার সমস্ত গুণ পুত্র আব্দুল হালিমের মধ্যে বিরাজিত ছিলো। খাজুরা এমএন মিত্র মাইনর স্কুলে প্রাথমিক লেখাপড়া করার পর তিনি ১৯৩৭ সালে খামার বাড়ী রাজঘাট থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে কলিকাতার লর্ড রিপন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে হায়ার সেকেন্ডারি ডিগ্রি লাভ করেন। পর পর বরিশালের চাখার ফজলুল হক কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে বিএ এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বিচক্ষণ । চাখার ফজলুল হক কলেজে পড়াকালীন সময়ে তিনি বাংলার বাঘ এ. কে. ফজলুল হকের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। লেখাপড়া শেষ করে তিনি সরকারি খাদ্য বিভাগের সিভিল সাপ্লাই অফিসার পদে ফরিদপুরে যোগদান করেন। ফরিদপুরে থাকাকালীন তিনি ফরিপপুর কোর্টের উকিল এডভোকেট আফসার উদ্দিন খান এর কন্যা সালেহা খানমের সাথে দাম্পত্য জীবন গ্রহণ করেন। ঐ সময় সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের চাকুরী গ্রহণের পর সেখানের দুনর্ীতি ও অব্যবস্থাপনা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন নিজ জন্মস্থান খাজুরার মির্জাপুর গ্রামে।
১৯৫৭ সালে তিনি খাজুরা এমএন মিত্র ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার দক্ষ ব্যবস্থাপনায় অচিরেই খাজুরা এমএন মিত্র ইনস্টিটিউশন একটি আদর্শ বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে মিত্র পরিবারের সদস্যরাই স্কুল পরিচালনা করতেন। কিন্তু তারা ভারতে চলে যাবার পর স্কুল পরিচালনা একটা অব্যবস্থাপনার মধ্যেই নিপতিত হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় কাজী আব্দুল হালিমের দক্ষ পরিচালনায় স্কুল নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। ৫৭ থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি খাজুরা স্কুলে ছিলেন। এর পর তিনি কালীগঞ্জ মাহাতাব উদ্দীন কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কালীগঞ্জ মাহাতাব উদ্দীন মহাবিদ্যালয়ে একাগ্রতায় তার দায়িত্ব পালন করেন। এর পর তিনি স্বপরিবারে যশোর চলে আসেন । এখানে তিনি একটি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয় গড়ে তোলেন। প্রসংগত: তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন থেকেই শিক্ষতার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাসেবা দিতেন। যশোরের বেলতলায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘কলেজ হোমিও হল’ এ নিয়মিতভাবে বসতেন। তিনি ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ে নিয়ে অনটনের মধ্যেও একজন আদর্শ পিতার ভ্থমিকা পালন করে গেছেন। তাঁর প্রত্যেকটি সন্তান আজ সমাজে সম্মানজনক অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত ।
কালীগঞ্জ কলেজে থাকাকালীন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এলাকার শিক্ষানুরাগী লোকজন নিয়ে খাজুরায় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কলেজের নামকরণ করা হয় শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন মহাবিদ্যালয়। ১৯৭৭ সালের ১৫ জুন মহাবিদ্যালয়ের দুঃসময়ে এলাকাবসীর অনুেরাধে অধ্যক্ষ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রাদেশিক পরিষদের এবং ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নিবার্চনে স্বতন্ত্র প্রাথর্ী হিসাবে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনও করেন। এ সময় তাঁর মায়ের মৃত্যু হলে মানষিকভাবে তিনি ভেঙ্গে পড়েন। এরপর তিনি রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। ১৯৮২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন কলেজ থেকে অবসর নিয়ে চিকিৎসা সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁকে ছাড়ল না। ১৯৮৬ সালে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় যশোর উপশহর মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং এখানেও সকলের অনুরোধে অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান। ১৯৯৩ সাল থেকে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর ২০০২ সালের ২৯ মার্চ তাঁর উপশহর বিরামপুরস্থ বাসায় সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ অবস্থায় থেকে সকলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পরলোকগমন করেন। আমরা এই বরেণ্য কর্মযোগীর আত্মার শান্তি কামনা করি।
২০১২ সালের ৯,১০ও ১১ই মার্চ খাজুরা এম এন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে “গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র“ আয়োজিত গ্রামীন জীবনযাত্রা ও কৃষি প্রযুক্তি তথ্য,বীজ মেলার অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে দেশ তথা অত্র অঞ্চলের ৩০ জন গুনীজনের সম্মাননা প্রদান করা হয়। মরনোত্তর গুনীজন সম্মাননার মধে২০১২ সালের ৯,১০ও ১১ই মার্চ খাজুরা এম এন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে “গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র“ আয়োজিত গ্রামীন জীবনযাত্রা ও কৃষি প্রযুক্তি তথ্য,বীজ মেলার অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে দেশ তথা অত্র অঞ্চলের ৩০ জন গুনীজনের সম্মাননা প্রদান করা হয়। মরনোত্তর গুনীজন সম্মাননার মধ্যে এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের নিরলস এক কর্মযোগী বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী অধ্যক্ষ আব্দুল হালিম ছিলেন অন্যতম একজন।