।।লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল।।
এ্যাড. কাজী আব্দুস শহীদ লাল ১৯৩৯ সালের ২৮ নভেম্বর যশোর জেলার বাঘারপাড়ার বন্দবিলা ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কাজী আব্দুলগণি। শৈশব কেটেছে যশোর শহরের পুরাতন কসবায়। আব্দুস শহীদ লাল যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন ও পুরাতন কসবার ফকির আহমদ ইউপি মক্তবে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬০ সালে যশোর এমএম কলেজ থেকে বিকম পাশ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমকম ফইনাল ইয়ারে থাকাকালে আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় বিশেষ সামরিক আদালত ১৯৬২ সালে তাঁকে ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেন। এতে তার পড়াশোনায় ছেদ পড়ে।
পরে ১৯৬৪ সালে আয়কর উপদেষ্টা হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এলএলপি উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৭১ সালের ২ফেব্রুয়ারি আইজীবী হিসেবে সনদ লাভ করেন। ঐ মাসেই যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে আইন পেশায় যোগ দেন। পরে তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রাকটিসের সনদ অর্জন করেন। ৪০ বছরের বেশী সময় ধরে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত। এ দীর্ঘ সময় তিনি ৪ বার যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ও ৩ বার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি।
এর পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতি সমূহের নেতৃত্বে ৬ দফা দাবি আদায়ে মূখ্য ভুমিকা পালন করেন। খুলনা বিভাগীয় আহবায়কের দায়িত্ব পালন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয় ভূ’মিকা রাখেন।
সেই কৈশোরে সম্মিলনী স্কুলের ছাত্র থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে ছাত্র ইউনিয়নের শহর ও জেলা কমিটির নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ৬০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এমএম কলেজে শ্রেণী প্রতিনিধি ও বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিজত হন। স্কুলৈ প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র হিসেবে তৎকালীন ছাত্র নেতা রওশন আলী ও মশিউর রহামনের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় নামেন। ১৯৬০ সালে হামিদুর রহামন শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন
করায় জেরা থেকে তাকে বহিষ্কার করে প্রশাসন । পরে রাজশাহী কলেজের ফুলার হোস্টেলের সামনে আয়ুব বিরোধী মিছিল থেকে গ্রেফতার হন, এবং মার্শাল কোর্টে তার ১৪ বছর জেল হয়। এ সময় সারাদেশে তার মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতৃবর্গ আন্দোলন গড়ে তোলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৯ মাস পর তিনি মুক্তি পান। পরে তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করেন। তিনি সংগঠনের যশোর জেলা শাখার সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির সদস্য হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। তিনি এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। তিনি এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। যশোরের রিক্স্রা শ্রমিক, হোটেল রেস্তরা শ্রমিক ইউনিয়ন, দোকান কর্মচারী
ইউনিয়ন, মটর শ্রমিক ইউনিয়ন, লেদ শ্রমিক ইউনিয়ন, সেলুন কর্মচারী ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি/সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মেহনতি মানুষের সাথে থেকে সংগ্রাম করেছেন। তার অপর দুই ভাই কাজী আব্দুস ছাত্তার (দুলাল-মৃত) ও কাজী আব্দুস সবুর হেলাল বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাহবুবুল হক ও সিরাজুল ইসলাম খানের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। পোস্টাল ইডি কর্মচারী
ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলনে ভুমিকা পালন করেন।
ন্যাপ সদস্য থাকাকালে গোপনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। ন্যাপ থেকে অব্যাহতি নিয়ে সিপিবিতে যোগদান করেন। সিপিবির জেলা সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গণফোরামে যোগদেন।
বর্তমানে তিনি এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মন্ডলীর সদস্য। শুধু রাজনীতি নয় বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে আব্দুস শহীদ লালের আজম্মের সম্পর্ক। তিনি উদীচী যশোর সংসদের উপদেষ্টা, একই সাথে কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য। তির্যক যশোরেরও তিনি সভাপতি। এর আগে তিনি যশোর ইনস্টিটিউটের সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময় একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে শহরের চাঁচড়ার বেগম মমতাজ মনোয়ারাকে বিয়ে করেন এই সংগ্রামী মানুষ। মমতাজ মহিলা পরিষদের তৎকালীন সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে এ সংগঠনের সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি ৩ মেয়ে ও ১ ছেলের জনক। ছেলে মেয়েরা সকলেই সংসার ও কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে ¯œাতক, গৃহিনী। মেঝ মেয়ে যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষিকা। ছোট মেয়ে রবীন্দ্র ভারতীতে নৃত্যে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি স্বামীর সাথে নিউজিল্যান্ড প্রবাসী। এক মাত্র ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম সম্পন্ন করে ঢাকা জেলা বারের সদস্য হিসাবে আইন
পেশা শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য। বর্তমানে তিনি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ছেন। তার ছেলে-মেয়েরা সবাই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং চিন্তা-চেতনায় প্রগতিশীল। তিনি ২০২১ সালের ২০ মে যশোর কুইন্স হাসপাতালে হার্ডএাাটকে মৃত্যুবরণ করলে অগনিত মানুষ শোক সাগরে নিমজ্জিত হন।
২০১২ সালের ৯,১০ও ১১ই মার্চ খাজুরা এম এন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে “গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র“ আয়োজিত গ্রামীন জীবনযাত্রা ও কৃষি প্রযুক্তি তথ্য,বীজ মেলার অনুষ্ঠান হয়। ঐ অনুষ্ঠানে দেশের ৩০ জন গুনীজনের সম্মাননা প্রদান করা হয়েছিল।ঐ সময় জীবদ্দশায় গুনীজন সম্মাননার মধ্যে রাজনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বলিষ্ট কন্ঠস্বর যশোরের ভাষা সৈনিক এ্যাড. কাজী আব্দুস শহীদ লাল ছিলেন অন্যতম একজন। আমরা সকলে এই ভাষা সৈনিক এ্যাড. কাজী আব্দুস শহীদ লালের মৃত আত্মার শান্তি কামনা করি।