মোঃ মাসুম বিল্লাহ
ভুল করা মানুষের স্বজাত প্রবৃত্তি। কথায় বলে প্রথম মানুষ আর প্রথম ভুল। জীবনে কখনো ভুল করেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। টমাস আলভা এডিসন তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের পর তার কাছে জানতে চাওয়া হয় আপানি অসংখ্যবার ভুল করেছেন তার মানে তো আপনার মেধা কম? সাংবাদিকের প্রশ্নে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ আমার মেধা কম কিন্তু আমি যত বার ভুল করেছি প্রতিবার কিছু না কিছু শিখেছি। ভুলের মধ্য দিয়ে গিয়ে সফলতা পাওয়া যায়। আর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে পরিবর্তনের মধ্যে প্রকৃত সফলতা। কিন্তু কথা হচ্ছে ভুল থেকে যদি কেউ শিক্ষা না নেয়। তবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে অবস্থান হবে তার।
ইতিহাসের কথা বলছি, কিন্তু সে ইতিহাসের কথা শোনার মতো দিব্যদৃষ্টি সবার আছে কী? ২০২৪ সাল, বাংলাদেশে এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। এ ইতিহাসের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার অনাকাক্সিক্ষত পালাবদল ঘটেছে। নতুন ইতিহাস রচনার পেছনে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার সে স্বপ্নে পরশ পাথর হিসাবে কাজ করেছে। সে পরশ পাথরের স্পর্শ মৃত প্রায় জাতির বুকে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। তাই সাগরের টানে নদির গতির মতো প্রসবণ ধারা প্রবাহিত হয়েছে পাহাড়ের বুক চীরে। বাঙালি অদম্য জাতি। তাই জুজুর ভয় তাতারির মতো স্বাধীনচেতা মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আর মানুষের সে কাতারে শামিল হয়েছিল শিশু থেকে বৃদ্ধ, গ্রাম থেকে শহুরে,পাতাকুড়ানি থেকে আদুরে, সাধু থেকে চোর, ধার্মিক থেকে অধার্মিক সকলে।
মুদ্দা কথা নতুন বাংলাদেশে হবে সকলের। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় নতুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধারায় উৎসারিত। দীর্ঘ আওয়ামী শাসনে বিএনপি জামায়াতকে কোনঠাসা কারা যে প্রত্যয় লক্ষ্য করা গেছে এখনো আওয়ামী লীগকে সেই কোনঠাসা করার প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। মনবতাবিরোধী দমন পীড়ন, গুম খুন, বিচার বর্হিভুত হত্যাকান্ডে আওয়ামী দুঃশাসন জনমনে এক আতঙ্কের নাম। প্রত্যেকটি দলের কিছু মরালিটি থাকে। আর ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে মানুষ তার বাস্তাবায়ন ঘটায়। যার বহিঃপ্রকাশ ১৯৭১ সালের মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডে জামায়াত নেতাদের এবং ১৫ আগস্ট এর বর্বরতার বিচার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটা কতটুকু ঠিক না ভুল বা কতটুকু সঠিক মানদন্ড অনুসারে হয়েছে সেটা বিতর্কের বিষয়, আমি তা নিয়ে বলতে চাই না। বর্তমান সরকার সে পথে হাটলে খুব বেশি অবাক হব না। কেননা আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিচার না হলে জনমনে আরো ক্ষোভের জন্ম দেবে আর রাজনৈতিক দলগুলো আরো বেশি স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। তাই বলে তাদের অস্তিত্ব বিলোপ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৃত্যুর সামিল এবং তাও সম্ভব যদি দেশের মানুষের নাগরিকবোধ সেভাবে জন্ম নেয়। জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি বাহিনী বিলোপ করা হয়েছে। যদিও সেটি জার্মান নাগারিকদের দেশত্ববোধের পরিচয়। তবু এখনো অসংখ্য লোক পাওয়া যাবে যারা হিটলারকে মর্মে ধারণ করে।
সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশের টক অব দ্যা কান্ট্রি হিসাবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (লালমনিরহাট)তাপসী তাবাচ্ছুম উর্র্মি সে আগুনে ঘি ঢেলেছে। উর্মির কর্মকান্ড সরকারী চাকুরীবধি লঙ্ঘন সে বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই। সুতারাং তার শাস্তি হওয়া বাঞ্চনীয়, কারো কারো মতে তার ফাঁসি হওয়া উচিত। আপাতত দৃষ্টিতে বিষয়টি যতটা সহজ বা স্বাভাবিক মনে হলেও ব্যপারটা মোটেও স্বাভাবিক না।
প্রথমত উর্মির মতো অসংখ্য লোক আছে যারা বঙ্গবন্ধুকে মর্মে ধারণ করে। তারা তাকে বাংলাদেশের প্রাণ ভোমরা মনে করে। দ্বিতীয়ত তারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্যকে স্বীকার করে । তৃতীয়ত জামায়াতকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের ও বিএনপি তাদের বৈধতা প্রদানে অ্যাজেন্সি মনে করে। চতুর্থত তারা মানুষ হিসাবে অনুদার, এমনকি নিষ্ঠুর প্রকৃতির।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিগত পনের বছরের শাসন আমলে বাংলাদেশের জনগন উপলব্ধি করেছে। আর তার পরিত্রাণ চেয়ে জুলাই মাসে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সে দুঃশাসনের অবসানের সাথে সাথে মানুষের মনে নতুন ভাবনার জন্ম হয়েছে যে, মানুষ এখন স্বাধীন ভাবে তার মত প্রকাশ করতে পারবে। আর এই অভ্যুত্থানের সাথে অনেক আওয়ামী পরিবারের সন্তান ও বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের অনেকে সামিল হয়েছিল, হয়েছিল প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। তাদের চাওয়া পাওয়ার যায়গা তৈরী হয়েছিল সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব থেকে মুক্ত হয়ে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে চর্চা। কেননা বিগত সময়ে জামায়াত ও বিএনপির উপর দমন পিড়ীন ও রাজনৈতিক অধিকারে হস্তক্ষেপ অনেক আওয়ামী আদর্শের মানুষকে চরমভাবে মর্মাহত করেছে। ভোট ডাকাতির মতো ঘটনা এমনকি তারা স্বপক্ষের লোক হয়েও নিজের ভোট নিজে দিতে না পারার কষ্ট আত্মগ্লানিতে দহন করেছে।
এসবের মতো সরকার প্রধানের ক্ষমতার দম্ভ অনেক আওয়ামী পরিবারও স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি।তারা বিভিন্ন স্থানে এই অপকর্মে স্বপক্ষের লোক বলে মনের অজান্তে নিজেকে মানুষ হিসাবে ছোট ভাবেতে শুরু করে।তাছাড়া সমাজে পাতিনেতাদের আস্বাফলন ও নিজের প্রতিবেশির অব্যক্ত আর্তনাদ তাদের মনে নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে বঙ্গবন্ধু ও তার দলের নেতা কর্মীদের উপর বিগত পনের বছর অত্যাচারিত মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আবার তাদের ও পরিবর্তন প্রত্যাশীদের মর্মাহত করে। উর্মি তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কেননা সে বড় হেেয়ছে, বেড়ে উেেঠছে আওয়ামী গুণকীর্তনের মধ্য দিয়ে।
গত ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী অনেক তরুণ তরুণি উর্মির মতো মানসিকতার ধারক। পার্থক্য উর্মি সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বলেছে ফলে তার প্রকাশটা অন্যরকম। তবে এটা সত্য যে তার মতো অনেক লোক পথে প্রান্তরে একই ধারণা পোষণ করে। তবে মন্দের একটা ভালো দিক থাকে আর তা হলো উর্মি নিজের মনের কথা বলেছে, নির্ভয়ে বলেছে। কিছু দিন পূর্বে যারা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে মা জননী, উন্নয়নের অকুতোভয় সৈনিক, বাংলাদেশ রোল মডেলের রূপকার, ও বঙ্গবন্ধুকে মাথার তাজ ও মিথ্যা প্রশংসা করে বিভিন্ন কথার ফুলঝুরি পিছনে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেছে সেখানে উর্মি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আদর্শ সৈনিক রূপে।
কিন্তু পরিবর্তনের দৃশ্যমান কোন উদাহরণ যেমন এখনো চক্ষুগোচর হচ্ছে না, তেমনি সরকারের মুখে পরিবর্তনের কথা শুনে অনেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে পতিত স্বৈরাচারের স্বপক্ষে কথা বলাটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। উর্মি সেক্ষেত্রে আর একটু এগিয়ে। কেননা তার মতো একজন দায়িত্বশীল পর্যায়ের কনিষ্ঠ কর্মকর্তা পতিত স্বৈরাচারকে শুধু বৈধ্যতা দেয়নি বরং তার মনের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ অস্বাভাবিক আস্ফলন চরম মাত্রায় উদ্ধত্য করে তুলেছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বর্তমান সরকার প্রধানকে মহাশয় বলা এমনকি কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে বলার স্বাধীনতা পাওয়ার সক্ষমতা হয়তো আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। তাছাড়া চোখের সামনে ঘটে যাওয়া মৃত্যু শোক ও বিকলঙ্গ মানুষের হাহাজারিকে অবমুল্যায়ন করার মতো সময়ও আমাদের সামনে আসেনি। উর্মি বিচার বিভাগের লোক হওয়াতে বিচার কার্য সমাপ্ত হওয়ার পূর্বে নিজের চোখের সামনে দৃশ্যমান হত্যাকান্ডকে হত্যা আর জড়িত ব্যক্তিদের হত্যাকারী বলতে নারাজ। উর্মি মানসিক উৎকর্ষের এমন এক উচ্চ
পর্যায়ে অবস্থান করে যে, তার এমন গুণ দেখে মনে হয় নিজের আপনজন কাউকে হত্যা হতে দেখলে বিচার নাওয়া পর্যন্ত তাকে হত্যাকারী বলবে না। কিন্তু এদেশের মানুষের মানসিক উৎকর্ষ তার পর্যায়ে যেতে পারেনি বলে হয়তো গুরুজনকে মহাশয় সম্বোধন করাটা বেয়াদবি মনে করে।
তাছাড়া এখনো আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা নিজেদের কোন ত্রুটি চোখেতো দেখছেন না এমনকি তাদেও ভুলটা যে কী তাও মনে মন উপলব্ধির করতে পারছেন না। কেননা তারা মৃত্যুকে উন্নয়ন দিয়ে বিচার করেন। মৃত্যু উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসাবে যাদের কাছে বিচারর্য তারা আর যা হোক মানবিক হতে পারে না। পিরামিড তৈরির জন্য এমন আত্মদান যদি স্বাভাবিক না হতো তবে আজ জাতির কাছে পিরামিড বিস্ময়ের বস্তুতে পরিণত হতো কী করে!
আদর্শ বিচারের মানদন্ড মানুষের হাতে গেলে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হতে পারে। কিন্তু পবিত্র কুরআনের ঐশী বাণী “যে কোন একজন মানুষকে হত্যা করলো সে যেন পুরো জাতিকে হত্যা করলো (সূরা আল মায়িদাহ)”। হাদিসে আসছে, “সমগ্র মানুষ ও জ্বীন মিলে যদি অন্যায়ভাবে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করে তবে আল্লাহ সবাইকে জাহান্নামে পাঠাতে একবারও ভাববেন না।” আমরা মানুষ হিসাবে কতটুকু যে এ বাণীকে ধারণ করতে পারি তা ভাবনার বিষয়।
বিগত পনেরো বছরে সংস্কার শব্দটা উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে মানুষের কাছে। আমাদের অনেকের ধারণা হয়তো সিস্টেমে বদলালে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অর্ধশিক্ষিত মানুষের দেশে সিস্টেম বদলালে কোন পরিবর্তন হবে না। বরং উর্মির মতো মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনের সুফল তখন পরিলক্ষিত হবে যখন সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান ভালো সিস্টেমের মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনের মাধ্যমে সৎ, যোগ্য, নির্ভীক,আদর্শিক, বুদ্ধিমান ও মানব দরদী মানুষ গড়ে তুলতে পারলেই পরিবর্তন সুফল বয়ে আনবে।