ডেস্ক নিউজ।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে পুলিশ-প্রশাসন ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় দেশে রাতের ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী বেশকিছু কর্মকর্তা এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছেন। পুলিশ ও প্রশাসনের বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অনেককে করা হয়েছে ওএসডি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর ও রাতের ভোটের সহযোগী হিসেবে বিচার বিভাগের কাউকে এখনো চিহ্নিত করা হয়নি। দু-একজনকে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হলেও তাদের কারও চাকরি যায়নি।
তবে এবার অ্যাকশন শুরু হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে বিচার বিভাগের সুবিধাভোগী ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা সাবেক যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) বিকাশ কুমার সাহা, ঢাকার সাবেক মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) রেজাউল করিম এবং সাবেক অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম (এসিএমএম) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূরকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাদের ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আদালতে সাক্ষ্য দিতে গেলে ঢাকার তৎকালীন সিএমএম রেজাউল করিম এবং তৎকালীন এসিএমএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর তাকে অভ্যর্থনা জানান। এ অভিযোগের বিষয়েও দুই বিচারকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
গত ২ মার্চ ইস্যু করা এসব নোটিশে তাদের ১৫ দিনের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী বিচারক যারা ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে চার সদস্যের এই কমিটিতে একজন উপসচিব ও দুজন সিনিয়র সহকারী সচিব রয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
গত এক দশকে বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের পর আনিসুল হক আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলে ধীরে ধীরে কলুষিত হতে থাকে বিচার বিভাগ। আইন মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা ও এর আশপাশের আদালতে কর্মরত বেশ কিছু বিচারক মন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ায় তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন। অর্ধশত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে একটি অভিযোগও জমা পড়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা তাদের সম্পদের হিসাব দাখিল করেছেন। তাদের সম্পদের হিসাবে কোনো গরমিল বা অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের বিষয় খতিয়ে দেখছে মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আনিসুল হক আইনমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়মের মাধ্যমে সারা দেশের আদালতগুলোয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার লোক নিয়োগ করা হয়েছে। সব নিয়োগ হয়েছে মূলত টাকার বিনিময়ে। শুধু আদালতেই নয়, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও বড় ধরনের ‘নিয়োগ-বাণিজ্য’ করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী। নিয়োগ-বাণিজ্যের পাশাপাশি করেছেন বদলি ও মামলায় তদবির-বাণিজ্য। নিয়োগ, বদলি আর তদবির-বাণিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন। এভাবে অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় গড়েছেন নিজের ‘সিটিজেন ব্যাংক’। মন্ত্রীর এসব অপকর্মে সহযোগিতার জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক আইন সচিব মো. গোলাম সারওয়ার, সাবেক যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা, সাবেক উপসচিব মাহবুবুর রহমান সরকার ও শেখ গোলাম মাহবুব, মন্ত্রীর পিএস এম মাসুম, মন্ত্রীর সাবেক এপিএস রাশেদুল কায়সার ভূঁইয়া জীবন এবং পিএ আলাউদ্দিন বাবু ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ ছিলেন এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য।
এই সিন্ডিকেট মূলত আদালতের কর্মচারী নিয়োগ ও মামলায় তদবির বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তাদের অপকর্মের ফিরিস্তি খুঁজে বের করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আইন সচিবের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এ ছাড়া সিন্ডিকেটের সদস্যদের বেশ কয়েকজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারা বিদেশ পালিয়ে যেতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন। তাদের কারও কারও ফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে।
‘৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ’- গত ২ মার্চ ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ ও আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে আইন ও বিচার বিভাগের সাবেক যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহাকে (ওএসডি) নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে বলা হয়েছে, আইন ও বিচার বিভাগের ওএসডি কর্মকর্তা সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বিকাশ কুমার সাহা যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-১) হিসেবে কর্মরত থাকাকালে কক্সবাজার জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালত ও জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থায় কর্মচারীদের শূন্য পদে অভিযোগকারী মো. জাফর আহমেদসহ উক্ত অভিযোগে বর্ণিত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের চাকরি প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন। অভিযোগে উল্লিখিত বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে ঘুষ হিসেবে অগ্রিম ৪০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই চাকরিপ্রার্থীদের কোনো চাকরি প্রদান না করে ওই টাকা আত্মসাৎ করেন এবং টাকা প্রদানকারীরা ওই টাকা ফেরত চাইলে তিনি তার পদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়ার ভীতি প্রদর্শন করেন।
নোটিশে বলা হয়েছে, বিকাশ কুমার সাহার উক্তরূপ কার্য অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিবেচনাপ্রসূত ও অবিচারকসূলভ মনোভাব তথা একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার জন্য অপ্রত্যাশিত ও দুর্নীতিমূলক কাজ হিসেবে গণ্য, যা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭-এর বিধি ২(চ) ও ২(ঠ) অনুযায়ী যথাক্রমে অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ। সে কারণে ওই বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার উক্ত আচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭-এর ৩(২) বিধি অনুযায়ী আইন ও বিচার বিভাগের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (বর্তমানে ওএসডি কর্মকর্তা) বিকাশ কুমার সাহার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের ফটোকপি প্রেরণ পূর্বক আগামী ১৫ (পনেরো) দিনের মধ্যে বর্ণিত অভিযোগের বিষয়ে তার লিখিত ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে ওই নোটিশে। এ বিষয়ে বিকাশ কুমার সাহার কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
‘সজীব ওয়াজেদ জয়কে অভ্যর্থনা’- ঢাকার সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং-২ এর বিচারক (জেলা জজ) রেজাউল করিম চৌধুরী এবং ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত কর্মকর্তা (অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ) মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নুরের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষীকে গাড়ি থেকে এগিয়ে আনা এবং গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া-সংক্রান্ত অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্বৈরাচারী সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে কথিত হত্যা প্রচেষ্টায় পল্টন থানায় দায়েরকৃত মামলায় সাক্ষী হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় সাক্ষ্য দিতে ঢাকার তৎকালীন অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নুরের কোর্টে আসেন। সাক্ষী সজীব ওয়াজেদ জয় আদালত এলাকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার তৎকালীন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম চৌধুরী এবং ঢাকার তৎকালীন অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নুর তাকে এগিয়ে আনতে খাসকামরা থেকে বের হয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের গাড়ির কাছে যান এবং তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসেন। সাক্ষ্য প্রদান শেষে যাওয়ার সময়ও তাকে অনুরূপভাবে তারা গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসেন। অফিস সময়ে দাপ্তরিক তথা বিচারিক দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে মামলার সাক্ষীর প্রতি উক্ত বিচারকদ্বয়ের এরূপ কাজ অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিবেচনাপ্রসূত ও অবিচারকসুলভ মনোভাব হিসেবে বিবেচনার যোগ্য, যা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭-এর ২(চ) অনুযায়ী অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ। বিজ্ঞ বিচারকদ্বয়ের ওই আচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। নোটিশে তাদেরও ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। এ দুই কর্মকর্তার মধ্যে রেজাউল করিম চৌধুরীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। অন্য কর্মকর্তা বিদেশে চলে গেছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
‘ঢাকার সাবেক সিএমএম’র বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ- ঢাকার সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং-২-এর বিচারক (জেলা জজ) জনাব রেজাউল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও একটি জাতীয় দৈনিকে তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদ আমলে নেওয়া হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, অভিযোগে দেখা যায় যে, ঢাকার তৎকালীন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম চৌধুরী ডিবি হেফাজতে থাকা মামলার জব্দকৃত আলামত একটি ল্যান্ডক্লুজার গাড়িসহ অন্য আরেকটি গাড়ি নিজ হেফাজতে নিয়ে অবৈধভাবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। তা ছাড়া আইন ও বিচার বিভাগকে না জানিয়ে ঢাকার সিএমএম হিসেবে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় সাত কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন; আশিয়ান গ্রুপের একটি মামলায় বেআইনি প্রভাব খাটিয়ে পাঁচ কাঠার প্লট নেন; অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দ্বারা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে তিনতলা একটি বাড়ি নির্মাণ করেন ও চট্টগ্রামের জাকির হোসেন রোডের ইয়াকুব সেন্টারে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন; সিএমএম পদের অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একাধিকবার ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বিল পরিশোধ করেননি।
নোটিশে বলা হয়েছে, বিচারকের এরূপ কাজ অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিবেচনাপ্রসূত ও অবিচারকসুলভ মনোভাব হিসেবে বিবেচনার যোগ্য, যা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭ এর ২(চ) ও ২ (ঠ) অনুযায়ী অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ। বিজ্ঞ বিচারকের ওই অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। তাকেও ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।কালবেলা