মোঃ মাসুম বিল্লাহ। ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক অঙ্গনে এনসিপির আত্মপ্রকাশ একটি ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছে। এনসিপি এমন একটি সংগঠন যাদের জন্ম হয়েছে বিপ্লব থেকে। ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লবের ফসল এনসিপি। কিন্তু তারা এই বিপ্লবকে কতটুকু ধারণ করতে পারে এটা আজকে প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে বিপ্লবটা হয়েছিল সেখানে রাষ্ট্রের সরকারি পক্ষ বাদে বিপক্ষ ডান বাম সকল শক্তি মিলে রাষ্ট্রের স্বপক্ষের শক্তি বিতাড়িত করেছিল। আরো স্পষ্ট করলে দেখা যায় ১৯৭১ সালে যারা স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই শক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায় এদেশের আপামর জনতা। অর্থাৎ একদিকে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ অন্য দিকে বিরোধী ভিন্ন মতালম্বী সকল শক্তি।
মূলত ৫ আগস্ট এর ছাত্র জনতার এই অভ্যুত্থানে সকলে একত্রিত হতে পেরেছিল। কারণ সকলের ব্যথা ছিল এক। তারা সকলে শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত। তারা হারিয়েছিল তাদের কথা বলার অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ফলে হঠাৎ ঘটা এ বিপ্লবে অত্যাচারিত নিপীড়িত মানুষগুলা বিপক্ষ শক্তির সাথে একতাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ তখন সকলের বেদনা ছিল এক। ফলে কে কোন দল বা মতাদর্শে বিশ্বাসী তা মুখ্য হয় ওঠেনি।
সময় বদলেছে, মানুষের অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশে এনসিপির কোন অস্তিত্ব ছিল না। ৫ আগস্টের ফসল হিসাবে এনসিপির আত্মপ্রকাশ করে। তাদের আত্মপ্রকাশ একটা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থেকে। কিন্তু আত্মপ্রকাশের পূর্ব মতাদর্শ ও পরবর্তী মতাদর্শের সমন্বয়হীনতা প্রকট হচ্ছে। তারা রাজনৈতিক মতাদর্শ ঠিক করতে না পারার জন্য নানান ভাবে হোঁচট খাচ্ছে। ১৯৭১ এর পূর্ব এবং পরবর্তীতে যে সকল রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে তারা তাদের মতাদর্শের কারণে এদেশে জনপ্রিয় হয়েছে এবং সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে সরকার গঠন ও পরিচালনা করেছে।
কিন্তু এনসিপি এখনও সেখানে শিশু। যার ফলে তারা আদর্শগত নানান দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। তাদের রাজনৈতিক আদর্শ দাঁড় করাতে গিয়ে ৫ আগস্টে যাদের সাথে তারা ঐক্য করে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করে সফল হয়েছে আজ তারা তাদের স্ববিরোধিতাই অবতীর্ণ হচ্ছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী দীর্ঘ ৯ মাস অতিক্রম করে তারা তাদের রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ১৯৪৭, ১৯৭১ও ২০২৪ কে মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করতেছে। সমস্যাটা বাদে
এখানে। যে ৭১ কে তারা অস্বীকার করে ৭১ কে বিতাড়িত করেছে, সেই ৭১ কে আবার প্রতিষ্ঠিত করতেছে তাদের রাজনৈতিক আদর্শে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পরে তারা ৭১ এর মানবতা বিরোধী অপরাধী দল মনে করে জামায়াতের বিপক্ষে কথা বলেছে। ৭১ কে তারা তাদের মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করে স্ববিরোধিতার জায়গাটা তৈরি করে ফেলেছে। কেননা ৭১ এ যারা বিরোধিতা করেছিল তাদের সাথে একত্রিত হয়ে, যারা একাত্তরের পক্ষের শক্তি ছিল তাদেরকে বিতাড়িত করেছে। আবার তারা নিজেরা ৭১ কে ধারণ করে রাজনীতি করতে চাচ্ছে এবং ৭১ বিরোধীদের বিপক্ষে যেও কথা বলছে। তখন জনমনে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কেন তারা এই ৭১ বিরোধীদের নিয়ে একত্রিত হয়ে,
আন্দোলন সংগ্রাম করে একাত্তরের শক্তিকে বিতাড়িত করল? ৭১, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ এ তিনটি ত্রয়ী সূত্র একত্রে গাঁথা। ফলে এর থেকে কোন একটি বাদ দেওয়ার অবকাশ রাখে কিনা সেটা আজকে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে এনসিপির জন্য?
তাদের দলের আদর্শের জন্য ৭১ কে স্বীকার করতে গিয়ে ৫ আগস্ট কে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাদের এই দ্বিধা জনমনে হতাশার জন্ম দিচ্ছে। জনগণ আশা করেছিল ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশ হবে উদার, অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের বাংলাদেশ। যার আদর্শ হবে অসাম্প্রদায়িক, উদারতা, অতীত স্মৃতি ভুলে সৌহার্য্য ও সম্প্রীতির মেল বন্ধনের বাংলাদেশ। কিন্তু সেখানে তারাও সেই সংকীর্ণতার পরিচয় দিতে শুরু করেছে। ৫ আগস্ট হতে পারতো নতুন বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি। কিন্তু তারা জুলাইয়ের এর পরিবর্তে ৪৭, ৭১ কে ভিত্তি টেনে জুলাইয়ে যাদেরকে নিয়ে ঐক্য গড়ে লড়াই সংগ্রাম করে বিজয় অর্জন করেছে, তাদেরকে আজকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।