এ. এইচ. এম আজিজুল ইসলাম।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক ভয়াবহ দিন — ১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনার চুকনগরে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ সামরিক গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার-আলবদর বাহিনী যৌথভাবে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেদিন প্রাণ হারান প্রায় ১৩ হাজার নিরীহ বাঙালি, যাঁরা অধিকাংশই ছিলেন সংখ্যালঘু হিন্দু এবং যুদ্ধাপরাধের ভয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া সাধারণ মানুষ।
চুকনগর ছিল পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তঘেঁষা একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, যেখান দিয়ে মানুষ ভারতে পালানোর চেষ্টা করছিল। খুলনা ও বাগেরহাট থেকে নদীপথে ভদ্রা নদী পাড়ি দিয়ে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এখানে জড়ো হয়েছিলেন সীমান্ত পার হওয়ার আশায়। কিন্তু সেই আশ্রয়স্থলই হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ।
বেলা ১১টার দিকে পাকবাহিনীর দুটি দল একটি ট্রাক ও একটি জিপযোগে এসে চুকনগরের উত্তর প্রান্তে কাউতলা এলাকায় অবস্থান নেয়। এরপর হঠাৎ করেই শুরু হয় নির্বিচার গুলিবর্ষণ। পাতখোলা বাজার থেকে শুরু করে চুকনগর বাজার পর্যন্ত বিকেল তিনটা পর্যন্ত চলে হত্যাযজ্ঞ। নারী, পুরুষ, শিশু— কেউই রেহাই পায়নি।
নিহতদের মরদেহের স্তুপ পড়ে যায় রাস্তা ও নদীতীরে। পাক সেনারা মৃতদেহগুলো ভদ্রা নদীতে ফেলে দেয় এবং স্থানীয়দের বাধ্য করে বাকি দেহগুলো পানিতে ভাসিয়ে দিতে। হত্যার ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, দীর্ঘ সময় ধরে নদীর পানি লাল হয়ে ছিল।
আজও চুকনগরের মানুষ সেই বিভীষিকার দিন ভুলতে পারেনি। সেই গণহত্যার স্মরণে স্থাপন করা হয়েছে “চুকনগর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ”। প্রতি বছর ২০ মে সেখানে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা ও ভুক্তভোগীরা। তবে এখনো এই গণহত্যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি, যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয়রা।
চুকনগর গণহত্যা শুধু একটি জনপদের ইতিহাস নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগের এক জ্বলন্ত দলিল।