লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল
সাবেক কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট নেতা নূহ আলম লেনীনসহ কৃষি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী,সচিব, বিজ্ঞানী সাংবাদিকদের আমন্ত্রন জানিয়ে নিয়ে গেছেন যশোরের কৃষকের মাঠে। সেই কৃষক সংগঠক আইয়ূব হোসেন এর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী ১৬ জানুয়ারী রবিবার।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের এ যুগে পরোপকারের এক উজ্জ্বল নির্দশন কৃষক সংগঠক আইয়ূব হোসেন। এ দেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য যিনি নিস্বার্থ নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। এই আইয়ূব হোসেন যশোর জেলা তথা সারা দেশের দরিদ্র কৃষকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি মুখ। যশোরের বাঘারপাড়ার বন্দবিলার কটুরাকান্দি গ্রামে ১৯৪২ সালের ২৪শে এপ্রিল জন্মেছিলেন আইয়ূব হোসেন। পিতা আবু বক্কার শিকদার ও মাতা কদভানু বিবির দুই পুত্র ও পাঁচ কন্যার মধ্যে আইয়ূব হোসেন বড়।
তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা বিজয় চন্দ্র রায়ের সাথে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আইয়ূব হোসেন ৬ষ্ট শ্রেনীর ছাত্র অবস্থায় ১৯৫৬ সালে কৃষক সমিতির হয়ে কাজ শুরু করেন কিশোর আইয়ূব। কিশোর বেলা থেকেই সাংগঠনিক মনোভাব অর্থাভাব,অনিয়ম আর বাউন্ডুলে জীবনের কারনে ১০ম শ্রেনীর পর আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি তার।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির (সিপিবি) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন আইয়ূব হোসেন। কিন্তু পল্লীমায়ের হাতছানি,মাটি আর মানুষের প্রতি ভালবাসার টানে রাজনীতির কুটিল আবর্ত আটকে রাখতে পারেনি সাদামনের এই মানুষটিকে। মা মাটির টানে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে যুক্ত হন কৃষি গবেষনায়। বাবলা গাছের বীজ জোগাড় করে লাগিয়ে দেন বন্দবিলা,কামারগন্নে,চৈত্রবাড়ীয়া,খালিয়া,জহুরপুর ও কটুরাকান্দিসহ বিভিন্ন গ্রামের রাস্তার দুই ধারে। তাতেই তার নাম হয় গাছ পাগল আইয়ূব।
শালিখার কাতলী গ্রামের মাষ্টার শামসুর রহমানের নয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সাহিদা বেগমকে ১৯৬৯সালে তিনি বিয়ে করেন। আইয়ূব হোসেনের একমাত্র পুত্র বাবুল ও একমাত্র কন্যা স্বপ্নাকে বিয়ে দিয়েছেন। উভয়ে সন্তানের জনক জননী। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া আইয়ূব হোসেন ছোট বেলা থেকেই দেশের কৃষি কৃষকের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রান। সংসার ধর্মে উদাসীন আইয়ূব হোসেনের একান্ত সাধনাই ছিল কি করে গ্রামের মাঠের জমিতে ফসলের আবাদ বাড়ানো যায়।
সে চিন্তা থেকে ৮০‘র দশকে ঢাকার পল্টনে সিপিবির কেন্দ্রীয় অফিসে বাংলাদেশের কৃষি নীতির ওপর দুইদিনের কর্মশালায় যোগ দেন তিনি। কর্মশালায় কৃষিনীতির ওপর ধারনাপত্র উপস্থাপন করেন প্রখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী ড. গুল হোসেন ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. ইলিয়াস। কর্মশালার উত্থাপিত বিষয় ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় নতুন পথের সন্ধান পান আইয়ূব হোসেন। নেমে পড়েন কৃষি ও কৃষকের সেবায়। সেই থেকে আইয়ূব হোসেন দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন।
বিজ্ঞানী ও অভিজ্ঞজনদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে মানুষকে সংগঠন ও চাষের ব্যাপারে সচেতন করে তোলার প্রানান্ত চেষ্টা চালিয়েছেন। সাবেক কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী,আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট নেতা নূহ আলম লেনীনকেও নিয়ে গেছেন গ্রামের কৃষকের দোর গোড়ায়। এছাড়া কৃষি বিষয়ক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কৃষি সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী,মন্ত্রী, সচিব, সাংবাদিকদের আমন্ত্রন জানিয়ে নিয়ে গেছেন।তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন কৃষকের সমস্যা ,সংকট ও সম্ভাবনার কথা। এ সুবাদে তিনি দেশের কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদদের প্রিয়জন হয়ে ওঠেন।
তিনি তাঁর চারপাশের কৃষকদের অবস্থা দেখে উপলদ্ধি করেছিলেন যে সংগঠিত উদ্যোগ ও কৃষির আধুনিকায়ন ছাড়া এদেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন সম্ভব নয়।তাই তিনি আশির দশকের গোড়ার দিকে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তার সহযোগি সাংবাদিক লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডলকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার ৬০টি গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন ৬৪টি কৃষি ক্লাব।
কৃষি বিপ্লবেরএই দুই দিক পালের উদ্যোগে ২০০১ সালে গাইদঘাট গ্রামে স্থাপিত হয়েছে কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র। এই কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র ৬৪টি কৃষি ক্লাবকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে। আইয়ূব হোসেনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এলাকার কৃষকেরা বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত। এ এলাকার অন্তত দশ সহস্রাধিক কৃষক কৃষির বিভিন্ন বিষয়ে সরকারী বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রশিক্ষন লাভ করেছেন এবং এসব প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগাচ্ছেন।
তিনি তার এলাকার কৃষকদের ভাগ্যান্নয়নের পন্থা হিসেবে স্থানীয় ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর দরিদ্র মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল এদেশের সকল স্থানীয় ও প্রাকৃতিক সম্পদ গুটিকয়েক সর্বগ্রাসী ব্যক্তির কুক্ষিগত, যাদের রয়েছে অর্থ ও পেশীশক্তি। পাশাপাশি দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রও এদের পৃষ্ঠপোষক। জনাব আইয়ূব হোসেন অসীম সাহসিকতা ও ধৈর্যের সাথে এ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক কারণে সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার ভাগ বেশি হওয়া সত্তে¡ও তিনি দমে যাননি।
১৯৯৪-৯৫ সালে তিনি তার সংগঠনের দারিদ্র মানুষের সাথে নিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সহযোগীতায় স্থানীয় রাজাপুর বিলের খাস জমিতে ধানের সঙ্গে মাছ চাষ শুরু করেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের মদদপুষ্ট স্থানীয় ভূমিগ্রাসী মহল তার এই উদ্যোগকে গ্রাস করে নেয়। এতে হতোদ্যম না হয়ে তিনি আবারও তাঁর সংগঠনের উদ্যোগে স্থানীয় শুড়ো-জলকর সড়কের দু’ধারে দুই কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে বৃক্ষরোপণ করেন।এক্ষেত্রেও একইভাবে সেই দখলদার শ্রেনী তার এই উদ্যোগকে গ্রাস করে নেয়। বাধা দিতে গিয়ে এখানেও দু’জন দরিদ্র মানুষ প্রান হারান এবং মিথ্যা মামলা ও বলপ্রয়োগে আইয়ূব হোসেনকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
একপর্যায়ে তিনি চলে যান ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচান্দা গ্রামে বন্ধু ওমর আলীর আশ্রয়ে। সেখানে তিনি ওমর আলীর সাথে মিলে সে গ্রামের চেহারা পাল্টে দিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে সুযোগ পাওয়া প্রচেষ্টায় সহযোগি বন্ধু সাংবাদিক লক্ষ্মন চন্দ্র মন্ডলকে নিয়ে বন্দবিলা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করেন বীজ প্রযুক্তি পল্লী। উভয়ের প্রচেষ্টায় যশোরের গাইদঘাট গ্রামে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের কাজ শুরু হয়। যে কারনে বিষ মুক্ত সবজি উৎপাদনের মডেল এলাকা হিসাবে যশোর জেলা সারা বিশ্বের মধ্যে স্থান পায়।
আজীবন পরহিতব্রতী এই মানুষটি বার্ধক্যজনিত নানাবিধ শারীরিক সমস্যা নিয়েও এলাকার কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে নিরলস কাজ করে গেছেন। ২০১১ সালে এই আইয়ূব হোসেনের উদ্যোগে বাঘার পাড়া উপজেলার খাজুরা মনিন্দ্রনাথ মিত্র স্কুলে দেশের একমাত্র মিত্র বাহিনীর স্মৃতি স্তম্ভ নির্মিত হয়। আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট নেতা নূহ আলম লেনীন এই স্মৃতি স্তম্ভটি নির্মান করেন।
এই আজীবন সংগ্রামী কৃষক নেতা,নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনের পুরোধা কৃষি বান্ধব সফল কৃষক সংগঠক আইয়ূব হোসেন ২০১৬ সালের ১৬ই জানুয়ারী ভোর ৭টায় যশোর সদর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেছিলেন ।্ ওইদিনই তার মরদেহ কঠুরাকান্দি গ্রামে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের পাশে সমাহিত করা হয়। তার যানাজায় দেশের স্বনামধন্য ব্যাক্তিবর্গ,আত্মীয় স্বজন,গুনগ্রাহী,গাইদঘাট কৃষিপ্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের ৬৪টি কৃষি ক্লাবের সংশ্লিষ্ট কৃষক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
তার মৃত্যুতে দেশের বিভিন্ন কৃষি বিজ্ঞানী,কৃষি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছিলেন। ২০১২ সালের ৯,১০ও ১১ই মার্চ খাজুরা এম এন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে “গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র“ আয়োজিত গ্রামীন জীবনযাত্রা ও কৃষি প্রযুক্তি তথ্য,বীজ মেলার অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে দেশ তথা অত্র অঞ্চলের ৩০ জন গুনীজনের সম্মাননা প্রদান করা হয়। ওই সময় জীবদ্দশায় গুনীজন সম্মাননার মধ্যে আইয়ূব হোসেন ছিলেন অন্যতম একজন।
দেশ সেরা এই কৃষক সংগঠকের ৬ষ্ঠ মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হবে ১৬ জানুয়ারী ২০২২ইং রবিবার তার কঠুরাকান্দি গ্রামে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের পাশে যেখানে তাকে সমাহিত করা হয়।