1. bdtelegraph24@gmail.com : Bdtelegraph Bangla :
  2. mirzagonj@bdtelegraph24.com : মির্জাগঞ্জ প্রতিনিধি : মির্জাগঞ্জ প্রতিনিধি
  3. islam.azizul93@gmail.com : তারিম আহমেদ : তারিম আহমেদ
যশোরের বিপ্লবী নেতা বিজয় চন্দ্র রায়ের স্মৃতি সংরক্ষন করা বর্তমান প্রজন্মের জন্য জরুরী - টেলিগ্রাফ বাংলাদেশ
বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ০৪:০৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :

যশোরের বিপ্লবী নেতা বিজয় চন্দ্র রায়ের স্মৃতি সংরক্ষন করা বর্তমান প্রজন্মের জন্য জরুরী

  • সর্বশেষ আপডেট : সোমবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২৪
  • ২১৯ জন খবরটি পড়েছেন
ছবি-বিডিটেলিগ্রাফ

।। লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল।।
১৯২৭ সালের প্রথম ভাগে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার জারিকৃত‘চৌকিদারী ট্যাক্স‘ এর বিরুদ্ধে সারা বাংলায় যে খন্ড খন্ড আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করে যশোরের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা গ্রামের সেই বিপ্লবী জননেতা বিজয় চন্দ্র রায়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যশোরের যে সব নেতা কর্মী অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এই বিপ্লবী জননেতা বিজয় চন্দ্র রায়ই ছিলেন অন্যতম।

বিজয় চন্দ্র রায় ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা ১৩০৪ সালের ২২ আশ্বিন বিজয়া দশমী তিথিতে যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাক্ষণ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ষষ্টিধর রায়। মাতা ছিলেন দেবী মোক্ষদা সুন্দরী। বিজয় রায় ছোট বেলা থেকেই স্বাধীনচেতা মনের মানুষ ছিলেন। ছাত্রজীবনেই তিনি যুগান্তর দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্বদান করতে থাকেন। এর মধ্যে নীলচাষ বিরোধী আন্দোলন ছিল অন্যতম। স্নাতক পরীক্ষা দেয়ার আগে তিনি সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

আজীবন সংগ্রামী এই জননেতা ১৯২৬ সালে যশোর জেলার কংগ্রেসের জন্য একটি নিজস্ব ভবন ক্রয় করে সেখান থেকেই ব্রিটিশ সরকারের জারিকৃত চৌকিদারী ট্যাক্স এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন। যা পরবর্তীতে সারা বাংলায় স্বদেশী আন্দোলনের রুপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকারের দমন পীড়ন নীতির বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কার্যক্রম অনুসারে ‘আইন অমান্য‘ আন্দোলন আরো তীব্র হলে ব্রিটিশ সরকারের দমন পীড়ন নীতি কঠোর থেকে কঠোর হয়। এ সময় বিজয় চন্দ্র রায়কে গ্রেফতার করে ভারতের দেউলী জেলে আটকে রাখা হয়।

এদিকে যশোর জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট লারকিন ও পুলিশ সুপার এলিসন এলাকায় শাসনের মাত্রা অনেকটা বাড়িয়ে দিয়ে এক শীতের রাতে পুলিশ বাহিনী সহযোগে কেশবপুর ভলান্টিয়ার ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ভলান্টিয়ারদের পাকড়াও করে। এ সময় তাদের উলঙ্গ করে কাপড় চোপড় পুড়িয়ে দিয়ে তাদের গায়ে গরম চিটাগুড় ঢেলে, তাদেরই বালিশের তুলা গায়ে জড়িয়ে তাদেরকে পুলিশ ভ্যানে করে যশোরের পর গদখালীর মাঠে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে অমানবিক নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিজয় চন্দ্র রায় এই অত্যাচারের কাহিনী দেউলী জেলে বসে শুনেই এক পত্র মারফত বিপ্লবীদের আরো সোচ্চার হওয়ার নির্দেশ দেন।
জেলখানায় বসে বিজয় চন্দ্র রায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবীরা সীতারামপুর ব্রিজের নিকট থেকে এলিসনের গাড়ী আটক করে তার দেহরক্ষী ও ড্রাইভারসহ ৬ জনের কাছের রক্ষিত অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে এলিসনের একটি কান কেটে নেয়। এসময় এলিসন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে বিপ্লবীরা তার বুকের উপর এক চিরকুট লিখে রেখে জানিয়ে দেয় ‘এক মাসের মধ্যে যশোর ত্যাগ করতে হবে।ব্যর্থ হলে হত্যা করা হবে।‘ এলিসন ১৫ দিনের মধ্যে যশোর ছেড়ে কুমিল্লায় চলে যান। কিন্তু সেখানে গিয়েও তার শেষ রক্ষা হয়নি। বিপ্লবীরা তার পিছু ধাওয়া করে অবশেষে ১২ বছরের এক বাদাম বিক্রেতাকে দিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে।

১৯৩৮/৩৯ সালে সংগ্রামী এই বিপ্লবী জননেতা বিজয় চন্দ্র রায়ের প্রচেষ্টায়, যশোর খুলনার রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনগুলো সবই যশোর বি,সরকার(তসবীর হল) অনুষ্ঠিত হতো। এ সময় বন্দবিলা ও দুর্বাডাঙ্গায় তিনি খাদি আন্দোলন এবং স্কুল কলেজ বয়কট আন্দোলন জোরদার করে গড়ে তোলেন।
নিজ বাড়িতে স্বদেশী আন্দোলনের দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি নিজের হাতে সুতা কেটে খদ্দর কাপড় দেশী তাতেঁ তৈরী করে ব্যবহার করতেন। ২ হাতে ২কোঁদাল ধরে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে পতিত জমি কোপাতেন বলে আজও বৃদ্ধরা তার গুনর্কীতন করে থাকেন। তিনি অত্র অঞ্চলের খ্যাতি সম্পন্ন ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। জনশ্রুতি আছে কোন এক মাঠে ফুঠবল খেলতে গিয়ে তার ছুড়া বলের তোড়ে গোল বাশেঁর উপরের আড়বাশেঁর মাঝখান থেকে ভেঙে পড়ে। বিজয় চন্দ্র রায় চ্যালেঞ্জ করেন ওই বাশঁ মাপ ছাড়া নিচু করে পোন আছে। অবশেষে চ্যালেঞ্জই সত্য হয়।

১৯৫৬ সালে পুর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মি. আতাউর রহমানের আমলে কংগ্রেস থেকে বিজয় চন্দ্র রায় এম এল এ নির্বাচিত হন। এ সময় ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা নেতাজী সুভাস বসু বন্দবিলায় বিজয় চন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসেন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়,বিধান চন্দ্র রায় প্রমুখের সহযোগীতায় তিনি বিপিসি ও এআইসি সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অত্যান্ত শিক্ষানুরাগী ছিলেন। এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য তার ভাই বসন্ত রায়কে সঙ্গে নিয়ে বন্দবিলায় তিনি একটি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। যা পরবর্তীতে বন্দবিলা বিজয় চন্দ্র রায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়েছে। বর্তমান এ বিদ্যালয়টিতে শত শত ছাত্র ছাত্রী উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। মৃত্যুকালে বিজয় চন্দ্র রায় তার সমস্ত অস্থাবর স্থাবর সম্পত্তি ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য উইল করে রেখে গেছেন।

যার পরিমান প্রায় ৯ একর জমি। বর্তমান এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ তার স্মৃতি বিজড়িত বাসভবনটিও ধবংসের মুখে দাড়িয়েছে।এছাড়া বিদ্যালয়ে দানকৃত জমির আয়ের মোটা অংশ প্রভাবশালীদের হাতে লোপাট হচ্ছে। বিদ্যালয়ের পাঠদানেও ভাটা পড়েছে। বিদ্যালয়ের পরিবেশ নোংরা হয়ে পড়ায় বিজয় চন্দ্র রায়ের স্বপ্নসাধ ভুলন্ঠিত হচ্ছে। বেশ কিছুকাল আগে বিদ্যালয় কমিটির উদ্যোগে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বিজয় চন্দ্র রায়ের আবক্ষ প্রতিকৃতি প্রতিস্থাপন করে কমিটি প্রশংশিত হয়েছেন। ৮৮যশোর-৪ আসনের এমপি রনজিৎ কুমার রায় এই প্রতিকৃতির আচ্ছাদন উন্মুক্ত করেন।

বিজয় চন্দ্র রায়ের স্মৃতিবিজড়িত যশোরের সেই ক্রয়কৃত বাড়িটিতে বর্তমান হোমিওপ্যাথিক কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। তার ঘরবাড়িগুলো বর্তমান অযত্নে অবহেলায় জরাজির্ন হয়ে খসে খসে ভেঙে পড়ছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষার জন্য এ সকল বিষয় সংরক্ষন বর্তমান প্রজন্মের অবশ্য করনীয় হয়ে দাড়িয়েছে।
বিপ্লবী বিজয় চন্দ্র রায়ের বয়স যখন মাত্র ২১ তখন তার পিতৃবিয়োগ ঘটে। ৫২ বছর বয়স কালে পত্নী বিয়োগ হলে পরে আর কোনদিন তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করেননি। তিনি নলডাঙ্গার রাজ দরবারের পন্ডিত নৃসিংহ চন্দ্র ভট্টাচার্যের একমাত্র কন্যা শ্রীমতি লীনা রানীকে বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রী বিয়োগের পর একমাত্র কন্যা সন্তান দুধের শিশু কল্যানীকে নিয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে এই কল্যানীকে মাগুরার চন্ডীদাস চক্রবর্তীর বড় ছেলে সুধাময় চক্রবর্তীর সাথে তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। কল্যানী রায় বর্তমান কলিকাতায় রত্নগর্ভা হয়ে এখনও জীবিত আছেন। তার পুত্র কন্যারা সব উচ্চ শিক্ষিত হয়ে সরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসাবে চাকরী করে যাচ্ছেন।

সংগ্রামী বিজয় চন্দ্র রায় কোনদিন জন্মভূমি স্বদেশ ও রাজনৈতিক দল বদলের পক্ষে ছিলেন না। যার কারনে তিনি জীবনের শেষ দিনটিতেও বন্দবিলার বাড়িতে কংগ্রেসের আদর্শ নিয়েই বেঁচে ছিলেন। ওই সময় পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তাকে পশ্চিমবঙ্গে নেওয়ার জন্য সুরম্য অট্টালিকা বাড়ীর প্রলোভন দিলেও তা প্রত্যাখান করেছিলেন। শেষ জীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে কংগ্রেস ত্যাগ করে আওয়ামীলীগে যোগদানের কথা বললে তিনি বলেছিলেন“মুজিব,তা হয়না,দল ত্যাগ করা আর পিতার নাম পাল্টিয়ে বলা একই কথা“। এই আজীবন সংগ্রামী তেজস্বী জননেতা বিজয় চন্দ্র রায় ৮৪ বছর বয়সে ১৯৮২ সালে বাংলা ১৩৮৮ সালের ২২ পৌষ বৃহস্পতিবার পরলোকগমন করেছিলেন।

২০১২ সালের ৯,১০ও ১১ই মার্চ খাজুরা এম এন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে “গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র“ আয়োজিত গ্রামীন জীবনযাত্রা ও কৃষি প্রযুক্তি তথ্য,বীজ মেলার অনুষ্ঠান করে। এই অনুষ্ঠানে দেশের ৩০ জন গুনীজনের সম্মাননা প্রদান করা হয়। মরনোত্তর গুনীজন সম্মাননার মধ্যে বিজয় চন্দ্র রায়ই ছিলেন অন্যতম।

শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2024
Theme Customized By BreakingNews