স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা। খুলনা জেলা শিক্ষা অফিসার ফারহানা নাজের বিরুদ্ধে ডিসিমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কীমের আওতায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকগণের পেশাগত প্রশিক্ষণ কোর্সের অর্থ নয়-ছয় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, নিউ কারিকুলাম স্কীমের আওতায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকগণের পেশাগত প্রশিক্ষণ কোর্স (১০-১৪ জুন-২০২৪তারিখ পর্যন্ত ৫দিন) ও প্রোগ্রামিং এন্ড নেটওয়ার্কিং (১০-১৩ জুন-২০২৪তারিখ পর্যন্ত ৪দিন) খুলনা কোতয়ালী থানার দুটি ও খানজাহান আলী থানার দুটি মোট ৪টি ব্যাচের প্রশিক্ষণে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৪টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ বয়রা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও খুলনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে চার ব্যাচের প্রশিক্ষণই বয়রা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। খুলনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কোন প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়নি।
প্রশিক্ষণ নীতিমালা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ চারটি থানার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের তত্তাবধানে হওয়ার নির্দেশনা থাকলেও জেলা শিক্ষা অফিসার ফারহানা নাজ ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার অফিসের পছন্দের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দিয়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছেন। প্রশিক্ষণ নীতিমালা অনুযায়ী কোর্স সমন্বয়ক কোতয়ালী ও খানজাহান আলী থানার থানা একাডেমিক সুপারভাইজার হওয়ার কথা থাকলেও ডিস্ট্রিক্ট ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর ও গবেষণা কর্মকর্তাকে কোর্স সমন্বয়ক দেখিয়ে তাদের সম্মানী দেওয়া হয়েছে। অফিস সহায়ক হিসেবে একই ব্যক্তিকে (রাসেল) ২টি ভেন্যুতে ৪টি প্রশিক্ষনের পারিশ্রমিক হিসেবে ৯,০০০ টাকা প্রদান করা দেখানো হয়েছে। কিন্তু ৪টি স্বাক্ষরে কোনো মিল নেই এবং একই ব্যক্তিকে (দেলোয়ার) ৭,০০০ টাকা প্রদান করা হয়েছে সেখানেও স্বাক্ষরের কোন মিল নেই।
জেলা শিক্ষা অফিসের গবেষণা কর্মকর্তাকে ৪দিনে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে ২,৪০০ টাকা দেখানো হয়েছে। আবার একই সময়ে তাকে কোর্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবে ৩,৬০০ টাকা প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া উক্ত অফিসের ডিস্ট্রিক্ট ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটরকে ৪দিনে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে ২,৪০০ টাকা দেখানো হয়েছে। একই সময়ে তাকে কোর্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবে ৩,৬০০ টাকা প্রদান করা হয়েছে। যা উভয় ক্ষেত্রেই বিধিবহির্ভূতভাবে একই সাথে ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের পারিশ্রমিক ও কোর্স কো-অর্ডিনেটরের সম্মানী প্রদান করা হয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসে কর্মরত গবেষণা কর্মকর্তা, ডিটিসি ও সহকারী পরিদর্শক সমগ্র প্রশিক্ষণ সমন্বয় করেছেন। কিন্তু উক্ত অফিসের অন্য কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রশিক্ষণে সম্পৃক্ত না করায় এবং সম্মানী/পারিশ্রমিক প্রদান না করায় তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
তাছাড়া দুই কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে অর্থ আত্মসাতেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোতয়ালী ও খানজাহান আলী থানার থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদ্বয়ের স্বাক্ষর জাল করে (৩,৬০০+৩,৬০০) মোট ৭,২০০ টাকা, খুলনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভেন্যু প্রধান রেহেনা বেগমের (কোর্স সমন্বয়ক)স্বাক্ষর জাল করে (৩,৬০০+৩,৬০০) মোট ৭,২০০ টাকা এবং বয়রা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষকের (কোর্স সমন্বয়ক) স্বাক্ষর জাল করে ৩,৬০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে দুপুরের খাবার বাবদ ৩০০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও ভ্যাট ও আয়কর বাদে (১৫%) মোট বরাদ্দ হচ্ছে ২৫৫ টাকা।
কিন্তু প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে খাবারের মান যথেষ্ট নিম্নমানের ছিল প্রশিক্ষণ চলাকালে ২দিন খাবারের মান নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে সে সময় জেলা শিক্ষা অফিসার বিষয়টি মীমাংসা করেন।
হোটেল ম্যানেজার এ রহমান হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট ও খুলনা কিচেন-এর সাথে আলাপকালে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে প্রতি প্যাকেট ১৮৫ টাকা হারে খাবার সরবরাহ করেছিলেন। প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর বরাদ্দ থেকে (২৫৫-১৮৫)=৭০টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সে হিসেবে ২ থানার পেশাগত কোর্স বাবদ (১৭৭+১৫১)=৩২৮জন ৭০টাকা হারে ৫দিনে ১,১৪,৮০০টাকা এবং প্রোগ্রামিং এন্ড নেটওয়ার্কিং কোর্স বাবদ (৯৪+৮১)=১৭৫ জন ৭০টাকা হারে ৪দিনে ৪৯,০০০টাকা। এছাড়া নাস্তা বাবদ বরাদ্দ জনপ্রতি ৮০ টাকা যা ভ্যাট ও আয়কর বাদে ৭২টাকা খরচ করার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ৪০টাকার নাস্তা সরবরাহ করেছিলেন। সে প্রেক্ষিতে দুই থানায় পেশাগত কোর্সে নাস্তা বাবদ আত্মসাৎ করা হয়েছে ৭২-৪০= ৩২৮ জন ৩২ টাকা হারে ৫দিনে ৫২,৪৮০টাকা এবং প্রোগ্রামিং এন্ড নেটওয়ার্কিং কোর্সে নাস্তা বাবদ আত্মসাৎ করা হয়েছে ৭২-৪০= ১৭৫জন ৩২ টাকা হারে ৪দিনে ২২,৪০০টাকা। ভেন্যু ম্যানেজমেন্ট ও ট্রেনিং কিটস বাবদ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
ভেন্যু ম্যানেজমেন্ট বাবদ ৪টি কোর্সে বরাদ্দ ছিল ১৫,০০০+১৫,০০০+৮,০০০+৮,০০০ মোট ৪৬,০০০টাকা (১৮% ভ্যাট ও আয়কর বাদে) ৩৭,৭২০টাকা। কিন্তু প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখাতে কোনো টাকা ব্যয় না করে সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ট্রেনিং কিটস বাবদ ভ্যাট ও আয়কর বাদে ১৮০টাকা বারাদ্দ থাকলেও প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ফোল্ডার ৩০টাকা, প্যাড ৩০টাকা এবং কলম ১৫টাকা সর্বমোট ৭৫টাকা খরচ করা হয়েছে। অর্থাৎ পেশাগত ও প্রোগ্রামিং কোর্সে ১৭৭+১৫১+৮+৯৪+৮১=৫০৩জন১০৫টাকা হারে ৫২,৮১৫টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সার্বিকভাবে দেখা যায়, পেশাগত কোর্স (৫দিন) ১০-১৪ জুন ২০২৪ তারিখ এবং প্রোগ্রামিং এন্ড নেটওয়ার্কিং (৪দিন) ১০-১৩ জুন ২০২৪। এই দুই প্রশিক্ষণে খুলনা মহানগরীর ২টি থানার শিক্ষকমন্ডলী প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। উক্ত প্রশিক্ষণে স্বাক্ষর জাল করে আত্মসাৎকৃত ১৮,০০০টাকা, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের স্বাক্ষরের অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত ১৬,০০০টাকা, দুপুরের খাবার ও নাস্তা বাবদ ১,৬৩,৮০০+৭৪,৮৮০টাকা, ভেন্যু ম্যানেজমেন্ট বাবদ ৩৭,৭২০টাকা এবং ট্রেনিং কিটস বাবদ ৫২,৮১৫টাকা সর্বমোট ৩,৬৩,২১৫টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোতয়ালী ও খানজাহান আলী থানার থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদ্বয় জানান, তাদেরকে বা তাদের অফিসের কোন কর্মকর্তা/কর্মচারীকে উক্ত প্রশিক্ষণে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বা কোনো সম্মানীভাতা প্রদান করা হয়নি। খুলনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেহেনা বেগম (০১৭১৬- ৬৯৯০১০) জানান, তার বিদ্যালয়ে কোন প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া তাকে কোনো ধরণের সম্মানীভাতা প্রদান করা হয়নি।
বয়রা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক দীলিপ কুমার পাল (০১৭১১- ৭০৩৫০৯) জানান, তাকে প্রশিক্ষণে কোর্স সমন্বয়ক হিসেবে কোনো সম্মানীভাতা প্রদান করা হয়নি।তাছাড়া অভিযোগ রয়েছে অনলাইন এমপিওভূক্তিতে তার পছন্দের কর্মকর্তার মাধ্যমে যোগাযোগ করে অর্থের বিনিময়ে আবেদন সমূহ অগ্রায়ন করেন এই জেলা শিক্ষা অফিসার।
বিষয়গুলো সম্পর্কে জেলা শিক্ষা অফিসার ফারহানা নাজ (০১৭১২-১৬৭০১৮)জানান, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। একটি মহল তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করেছে।
এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের সম্মানী ও পারিশ্রমিক বঞ্চিত জেলা শিক্ষা অফিসের একাধিক কর্মকর্তা/কর্মচারী ও শিক্ষকমন্ডলী কারিকুলাম প্রশিক্ষণের বিভিন্ন অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।