নিজস্ব প্রতিবেদক। পেনশনের ফাইলে বন্দি বেসরকারি শিক্ষকদের জীবন। পেনশন মানেই টেনশন, অশেষ ভোগান্তি। দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী। দিনের পর দিন বুকের ভেতর পাথরসম কষ্ট চেপে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইট-পাথরের রাজধানীতে চক্কর কাটছেন কর্মজীবন শেষে প্রাপ্য অবসর ভাতাটুকুর জন্য। বয়সের ভারে মানুষ গড়ার নুইয়েপড়া কারিগররা বড় অসহায়। টাকা না পেয়ে অনেকে করতে পারছেন না চিকিৎসা, দারিদ্র্যের জালে আটকে হাজারো পরিবার।
অবসরে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদেরকে অবসরকালীন সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। একই সঙ্গে বেতন থেকে ১০ শতাংশ কেটে নেওয়া হলেও তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
অথচ চাকরি জীবন থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের অবসর সুবিধা পাওয়ার জন্য বোর্ডের শরণাপন্ন হলেও ৪-৫ বছরেও পাচ্ছেন না অবসর ভাতা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বয়সের ভারে ন্যুজ্ব শিক্ষকরা অবসর সুবিধার জন্য বোর্ডে গিয়ে ধরণা দেন।
এ প্রতিবেদকে যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার ভুক্তভোগী মাদ্রাসা শিক্ষক আব্দুর রহমান জানান, তিনি বাঘারপাড়া উপজেলার খানপুর সিদ্দিকীয়া দাখিল মাদ্রাসায় দীর্ঘ ৩৫ বছর সহকারি মৌলভী পদে চাকরি করার পরে বিধিমোতাবেক ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী চাকরি থেকে অবসর নেন । অবসর যাওয়ার পর ওই বছরের ২৮ /০২/২০২১ তারিখে অবসরভাতা ও কল্যাণ তহবিলের টাকার জন্য আবেদন করি। তাঁর অবসরভাতা আবেদনের আইডি নম্বর-০৬১৫১২ এবং কল্যান তহবিল আবেদনের আইডি নম্বর- ০৬১৫১২। তিনি জানান, অনেক ঘোরাঘুরির পরেও পান নি অবসর সুবিধার টাকা। দীর্ঘ চাকরীজীবনে বেতনের ৬-১০ শতাংশ অবসর ভাতা বাবদ কাটা হয়েছে । সেই অর্থসহ এখন তিনি অবসর ভাতা পাবেন। দ্রুত টাকা পাওয়ার জন্য দালাল ধরেও কোন লাভ হয়নি শুধু কিছু টাকা খরচ হয়ে গেছে। আক্ষেপ করে এই মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন, ৪ বছর পেরিয়ে গেলো আর কবে টাকা পাবো।
৩ ছেলে আর ২ মেয়ের জনক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুর রহমান জানান, প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পরে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসার আর চলছে না। নিজের একটা কাপড়ের ব্যবসা ছিলো সেটাও এখন করতে পারছি না। ওই ব্যবসা থেকে যা কিছু আয় হতো তাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে সংসার চলতো,সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই উচ্চ দ্রব্যমূল্যের বাজারে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। আশায় আশায় অপেক্ষা করছি কবে পাবো অবসর ভাতা।
এ বিষয়ে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধার বোর্ড সূত্র জানায় , বাজেট ঘাটতি কারণে শিক্ষক-কর্মচারীর অবসরভাতার অর্থ দিতে একটু দেরি হয়ে যায়। তবে মৃত্যুজনিত শিক্ষক-কর্মচারিদের এ অর্থ দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়। দেশের বিভিন্ন দূরপ্রান্ত থেকে শিক্ষকদের ঢাকায় এসে খোঁজ নেয়ায় অনেক কষ্ট হয় এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে অবসর সুবিধার বোর্ডের এক পরিচালক ব্যাক্তিগত অভিমত থেকে বলেন, আমার মনে হয় ঢাকার পাশাপাশি দেশের বড় বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে অবসর সুবিধার বোর্ডের অফিস কার্যক্রম পরিচালনা করলে ওই সকল শিক্ষকদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।
অবসর বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, প্রতি মাসে অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেন গড়ে ৯০০ জন শিক্ষক-কর্মচারী। যাঁদের পাওনা মেটাতে প্রয়োজন অন্তত ১১০ কোটি টাকা। অন্যদিকে টাকার উৎস হিসেবে ব্যাংকে ডিপোজিট করা আছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। সেখান থেকে প্রতি মাসে লভ্যাংশ আসে প্রায় তিন কোটি টাকা। শিক্ষকদের বেতনের কর্তন করা ১০ শতাংশ থেকে আসা টাকা মিলিয়ে অবসর ভাতা বাবদ এক মাসে যতটুকু সম্ভব পরিশোধ করা হচ্ছে। এতে নতুন করে প্রতি মাসে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
অবসরে যাওয়ার ৬ মাসের মধ্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক, কর্মচারীদের পেনশন দেয়ার নির্দেশ দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে ইতোমধ্যে অনলাইনে পেনশন আবেদন, হাজিরা প্রদান ও ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে পেনশনের টাকা স্থানান্তর চালু করেছে সরকার। তথাপি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অবসর/কল্যান ভাতার টাকা পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।