বিলাল হোসেন মাহিনী।। ভুলে যাওয়া মানুষের জন্মগত অভ্যাস। তাইতো, জীবনের হাজারও দুঃখ-কষ্ট, সুখ-শান্তির অতীত ভুলে যায় মানুষ সহসাই। ছয় মাস পার হয়নি, অথচ আমরা ভুলে যেতে বসেছি সহস্র ছাত্র-জনতার বিসর্জিত প্রাণ ও প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের অঙ্গহানি অহত ব্যথিত শারীরিক-মানসির যন্ত্রণার কাতরতা! দেড় দশক মানুষ বাক স্বাধীনতা থেকে, নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। একটি ফ্যাসিবাদি ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এই একটি দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফার আন্দোলন স্বৈরাচার বিদায়ের ১ দফায় পরিণত হয়েছিল। সেটাও ভুলতে বসেছি আমরা। এখন দেশের সবচেয়ে বড় দলটিও পতিত ফ্যাসিস্টদের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বয়ান দিচ্ছে। অথচ, এই দলের লক্ষ লক্ষ ত্যাগি নেতা-কর্মী বছরের পর বছর জেল-জুলুম, হামলা-মামলার শিকার হয়ে বিগত দেড় দশক নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছে ফ্যাসিস্টদের হাতে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তথা দেশের সব সেক্টরে যথাসম্ভব সংস্কারের উদ্দেশ্যে এতবড় ত্যাগ শিকার করল সহস্র লক্ষ জনতা। অথচ এখন সংস্কার যেন গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে কারো কারো কাছে। কেউ কেউ শুধু নির্বাচন ব্যবস্থার তড়িঘড়ি সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দিতে সরকারকে চাপ দিচ্ছে, এমনকি হুমকিও দিচ্ছে।
আসলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত স্পিরিট ধারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। তাইতো, আমাদের মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া অনেক গরুতর আহত ভাই, যারা এখনো মৃত্যু বরণ করে শহিদ হচ্ছেন, তাদের অনেকের জানাজায় যাওয়ার মতো সরকারের উপদেষ্টাদের খুঁজে পাওয়া ভার হয়েছে! আমরা নতুন বাংলাদেশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের কথা বলছি, কিন্তু এরই মধ্যে দখলদারি, চাঁদাবাজি ও পেশিশক্তির অপব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। পতিত সরকারের পাতি নেতারা যেভাবে বিরোধি মত-পথের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা-বানোয়াট ভুয়া মামলা দিত, ক্ষমতায় না গিয়েই একটি দলের নেতারা সেই একই ফ্যাসিবাদি আচরণ শুরু করে দিয়েছে বলে গণমাধ্যমের রিপোর্টে উঠে এসেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে ধারণ করা দরকার, তেমনিভাবে রাজনৈতিক দল ও দেশের সচেতন নাগরিকদেরও ধারণ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কার কাজে রাজনৈতিক দল ও দেশের সব স্টেকহোল্ডারকে যুক্ত করে দ্রুততার সাথে বাস্তবসম্মত একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। সাথে সাথে দেশের সকল রাজনৈতিক, পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে নিয়মিত ডায়লগ অব্যাহত রাখতে হবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে সংস্কার আনতে যথাযথ মনযোগী হতে হবে। কেননা, বিগত দেশ দশক বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ তো দূরের কথা, নিজের দলের নেতা নির্বাচনের জন্য দলীয় কাউন্সিলও করতে পারেনি। তাই, দলের মধ্যে আদর্শিক কর্মী তৈরি ও পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুশীলন অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে, জুলাই অভ্যুত্থানকে ধারণ করতে না পারলে এবং জাতীয় স্বার্থে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডাদের মধ্যে দর্ভেদ্য ঐক্য গড়ে তুলতে না পারলে বর্তমান সরকার যেভাবে ব্যর্থ হবে, তেমনি পতিত সরকারের প্রেতাত্মা এবং ভারতীয় আগ্রাসন-ষড়যন্ত্র থেকে কেউই রেহাই পাবে না। ভুলে গেলে চলবে না, পতিত ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোসররা বসে নেই, নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে তারা। ঐক্যবদ্ধভাবে এ সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে না পারলে, জাতিকে চরম খেরাসত দিতে হবে।