বিশেষ প্রতিনিধি।
সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে নতুন করে কোনো মসজিদ নির্মাণের ‘প্রশ্নই ওঠে না’ বলে মন্তব্য করেছেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন।
রোববার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে জেলা ওয়াকফ বিষয়ক সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে মতবিনিময় সভার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেন। পিআইডির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থভূমি সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মসজিদ নির্মাণের কথিত প্রস্তাব নিয়ে যে আলোচনা চলছে, সে প্রসঙ্গ ধরে উপদেষ্টা বলেন, “সেখানে কোনো প্রকার মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি এবং এ বিষয়ে প্রচারিত সংবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
“সীতাকুণ্ড প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চন্দ্রনাথ পাহাড় দেশের একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
“তাই এ পাহাড়ে নতুন করে কোনো মসজিদ নির্মাণের প্রশ্নই ওঠে না। ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি। সরকার ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
গত ১৫ অগাস্ট এম এম সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী ঢাকা থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পরদিন তিনি ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন।
হেফাজতে ইসলামের নেতা হারুন ইজহারের সঙ্গে একটি ছবি প্রকাশ করে ওই পোস্টে সাইফুল ইসলাম লেখেন- “সীতাকুণ্ড পর্বতের চূড়ায় মসজিদ ৯০ শতাংশ কনফার্ম।”
ফেইসবুকে ওই পোস্টটি ছড়িয়ে পড়লে সেখানে কেউ কেউ মসজিদ নির্মাণে আর্থিক সহায়তার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এ নিয়ে ফেইসবুকে আলোচনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মন্দিরের এলাকা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সীতাকুণ্ড শ্রাইন কমিটি তখন বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
তখন স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতা হারুন ইজহারের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এরপর ১৭ অগাস্ট ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন মুফতি হারুন ইজহার।
সেখানে তিনি লেখেন, “ঢাকার কিছু তরুণ আলেম উদ্যোক্তা গতকাল আমার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে আসেন। আমি তখন সফরে বের হচ্ছিলাম, মাত্র কয়েক মিনিট কথা হয় তাদের সাথে। সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ মন্দির এলাকায় কোনো মসজিদ নির্মাণের অভিপ্রায় তারা ব্যক্ত করেননি।
“তারা শুধু বলেছেন, পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত কোন জায়গায় একটা মসজিদ দরকার এবং এ বিষয়ে তারা অর্থায়নে আগ্রহী। আমি তাদের এর জন্য সাধুবাদ জানাই। আর আমিও মনে করি ইকোপার্ক অংশে মুসলিম পর্যটকদের সুবিধার জন্য ইবাদাতখানা নির্মাণের জন্য প্রশাসনের সাথে পরামর্শ করে একটা উদ্যোগ নেওয়া যায়।”
ওই পোস্টে হারুন ইজহার লেখেন, “কিন্তু বাস্তব ঘটনার বিপরীতে একটি মহল এ বিষয়ে প্রপাগান্ডা চালিয়ে হিন্দু সমাজকে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। ভুল তথ্য প্রচার করে ধর্মীয় উত্তেজনা না ছড়ানোর জন্য সবার কাছে অনুরোধ করছি।”
এই আলোচনার মধ্যে সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম, স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা ও শ্রাইন কমিটির নেতারা চন্দ্রনাথ পাহাড় পরিদর্শনে যান ১৭ অগাস্ট।
পরিদশন শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থিত বিভিন্ন মন্দির উপমহাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে পরিগণিত। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা নিয়মিত এ পাহাড় ও মন্দিরসমূহে দর্শন ও পূজা-অর্চনার জন্য আগমন করেন।
“সীতাকুণ্ড উপজেলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে সকল ধর্মের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে। পবিত্র তীর্থস্থানটির প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, অনুভূতি ও আবেগকে সীতাকুণ্ডবাসী গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়ে থাকে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে এমন কোনো কর্মকাণ্ডকে সীতাকুণ্ডবাসী কখনোই সমর্থন করে না।”
ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, “আজ (১৭ অগাস্ট) প্রশাসনের পক্ষ থেকে চন্দ্রনাথ মন্দির এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে, এবং সেখানে মসজিদ নির্মাণের কোনো উদ্যোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
“সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলকে আশ্বস্ত করা যাচ্ছে, চন্দ্রনাথ মন্দির এলাকায় মসজিদ নির্মাণের কোনো অনুমতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি।”
সোশাল মিডিয়ায় ‘গুজব, প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচার’ ছড়িয়ে সীতাকুণ্ডে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ ‘নষ্ট করার’ যে কোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস্ত করেন তিনি।
এরপর ১৯ অগাস্ট চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন হিন্দুদের বেদখল হওয়া দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, “সীতাকুণ্ডে খুব সম্ভবত দুই দিক থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মন্দিরে যাওয়া যায়। আমি যখন এমএ পাস করি, সীতাকুণ্ডে আমার এক বন্ধু ছিল। তার দাওয়াতে যাই। সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি সরু পথ খুব বিপদসঙ্কুল।
“ওখান থেকে পা পিছলায়ে পড়লে আপনাকে আর পাওয়া যাবে না। একটা পথ আছে মানুষ ওটা দিয়ে উঠে। আরেকটা অন্য দিক দিয়ে পথ আছে।”
তিনি বলেন, “আপনারা খোঁজ নেন, দেবোত্তর সম্পত্তি যদি নিষ্কন্টক হয়, কোনো মামলা যদি কোর্টে পেন্ডিং না থাকে, আমাদেরকে জানান। আমরা গভার্নমেন্ট গিয়ে দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধার করে দেব। মতিঝিলে লক্ষ্মী নারায়ণ জিউর মন্দির–এটা আমরা উদ্ধার করে দিয়েছি।”
সবশেষ রোববার চট্টগ্রামের আরেক অনুষ্ঠানে ধর্ম উপদেষ্টা বললেন, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে নতুন করে কোনো মসজিদ নির্মাণের ‘প্রশ্নই ওঠে না’।
সনাতন ধর্ম মতে পৌরাণিক স্মৃতিবিজড়িত বেশ কিছু মঠ-মন্দির আছে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে সেখানে শিবচতুর্দশী মেলা হয়। সেখানে প্রায় ১০ লাখ লোকের সমাগম হয় প্রতি বছর।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের এই তীর্থ স্থানে শিব মন্দির, চন্দ্রনাথ মন্দির, স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির, বীরুপাক্ষ মন্দির, ভোলানাথ গিরি সেবাশ্রম, দোল চত্বর, শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরসহ বিভিন্ন মঠ-মন্দির আছে।
ধারণা করা হয়, চন্দ্রনাথ মন্দিরের নির্মাণকাল ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।