।। লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল।।
খানপুর গ্রাম তথা অত্র অঞ্চলে শিক্ষার প্রথম বাতি জ্বলেছিল যার হাতে সেকথা বলতে গেলে প্রথমেই স্মরণ হয় সর্বজন শ্রদ্ধেয় সেই মাষ্টার নিত্যানন্দ ভদ্রের কথা। যারাই লেখাপড়ায় একআধটু হাতে খড়ি নিয়েছিল তাদের কারোরই এই নামটি অস্বীকার করা্র কোন উপায় নেই। বাঁেশর কঞ্চির কলম হাঁড়ির পিছনের কালি আর তাল পাতায় তিনিই বাচ্চাদের হাতে খড়ি দিয়ে স্কুলে লেখাপড়ার উদ্বোধন করাতেন।
শিক্ষা একটা অব্যাহত জীবন ব্যাপী প্রক্রিয়া। মুলত: একটা মানুষ যখন বিদ্যা শিক্ষা ও জ্ঞান আহরণের জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় ব্যয় করেন সেই সময়টাকে বলা হয় ছাত্র জীবন। ছাত্র জীবনের প্রধান কাজ হচ্ছে লেখাপড়া।
শিক্ষা একটা আলোক বর্তিকা। এর দ্বারা নিজে যেমন আলোকিত হওয়া যায় তেমনি অন্যকে তথা দেশকেও আলোকিত করা যায়। শিক্ষা একটা সোনার পরশ কাঠি। এর স্পর্শে অমানুষও মানুষ হয়। শিক্ষার অন্য নাম জাগরণ। এর দ্বারা ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করা যায়। শিক্ষা বিনয় দান করে, শিক্ষা মানবিকতা ও ভদ্র আচরণ করতে শিক্ষা দেয়। শিক্ষায় সভ্য হওয়া যায় ও ভব্য হওয়া যায়। শিক্ষায় চিত্ত পাওয়া যায়-বিত্ত পাওয়া যায়। শিক্ষার দ্বারা আমার আপনার ও সকলের মধ্যে যে একটা অচিন পাখী আছে সে সকলকে ভালবাসার গান শোনায়। তেমনি এক মানুষ গড়ার কারিগর-ক্ষনজন্মা মহৎ ও নিবেদিত প্রাণ হচ্ছেন শিক্ষক নিত্যানন্দ ভদ্র। তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি পুজনীয় আরাধ্য দেবতুল্য চির ও নিরন্তর প্রনম্য সবার। তিনি ইংরেজী ১৯১৩ সালের ২০ শে অক্টোবর রোজ রবিবার রাত ৮টা ১০ মিনিটে মাতা ঠাকুর দাসীর কোল আলো করে খানপুর গ্রামেই জন্মেছিলেন মাস্টার নিত্যানন্দ ভদ্র। পিতা লালবিহারী ভদ্রের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
ইংরেজী ১৯২০ সালে তিনি প্রথম লেখাপড়া শুরু করেন। পরে ইংরেজী ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বন্দবিলা বিজয় চন্দ্র রায় উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর জি টি প্রশিক্ষণ নিয়ে ইংরেজী ১৯৩৬ সালে খানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। অগনিত ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে তিনি নিজ হাতে জ্ঞানের প্রদীপ জো্বলে দিয়ে তাদেরকে সফলতার স্বর্নদুয়ারে পৌছে দিয়েছিলেন ও তাদের স্বার্থকতার ধ্রবতারা টিকে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত করে তুলেছিলেন। তিনি বলতেনÑ“ছাত্র্যনাং অধ্যয়নং তপঃ।“ছাত্রদের অধ্যয়ন করাটাই হচ্ছে তপস্যা। তিনি আরো বলতেন Ñ তোমরা পড়,ভাল হও ,মানুষের মত মানুষ হও, দেখবে একদিন তোমরা ফুলের মত ফুটে উঠে সৌরভ ছড়াচ্ছ। মনে রাখবে ধুপের মত পুড়ে পুড়ে তোমাদের গন্ধ বিলাতে হবে আর চন্দনের মত ক্ষয়ে ক্ষয়ে তোমাদের সুবাস ছড়াতে হবে। তিনি অনেককে জ্ঞানরাজ্যের রাজা করে দিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন সোজা-ছাপটা,সহজ সরল,সাদা সিধে,দিল খোলা,উদার অমায়িক,অহংকার শুন্য দুর্লভ-সুন্দর এক স্বাধীন চেতা উচু মনের মানুষ। ১৯৪১ সালের ১০ জানুয়ারী একই উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের বনেদী ও সম্ভান্ত রামপদ হালদারের একমাত্র কন্যা কৃষ্ণদাসী হালদারের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। তিনি ৪ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। পুত্রদের মধ্যে ১ম জন চিত্তরঞ্জন ভদ্র বি কম বি এড খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২য় জন সত্যরঞ্জন ভদ্র বি এ এস আই হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ৩য় জন অরবিন্দু ভদ্র বি এ অনার্স এম এ সোনালী ব্যাংকের উচ্চ পদস্ত অফিসার ছিলেন। ৪র্থ জন বিনয় কৃষ্ণ ভদ্র ইঞ্জিনিয়ার- বৃহৎ এক শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। মাষ্টার নিত্যানন্দ ভদ্র শিক্ষিত মনা সচেতন মানুষ ছিলেন বলেই সব ছেলেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে যেতে পেরেছেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বড়দাদা ও মেজদাদার সঙ্গে চাষাবাদ করতেন। হাল চাষ নিজ হাতে না করলেও চাষবাস সম্পর্কিত অন্যান্য সকল কাজ নিজে করে করে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নতিসাধন করেছিলেন। এসব কিছুর বাইরেও আর একটি মহান পেশায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সেটি হলো আয়ুর্ব্বেদীয় চিকিৎসা অর্থাৎ কবিরাজী চিকিৎসা। কবিরাজী চিকিৎসায় তিনি গ্রামবাসী সহ অত্র অঞ্চলের অনেক মানুষের সেবা করে সকলের প্রভূত উপকার করে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাই অনেকে তাকে “নিতাই মাস্টারের“ পাশা পাশি ‘‘কোবরেজ মশায়“ বলেও সম্বোধন করতেন।
খানপুর দেব মন্দির এর পুজা কমিটির সাধারন সম্পাদকের পদে দির্ঘদিন অধিষ্ঠিত থেকে বিভিন্ন পুজা উৎসবাদি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করে ভুয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। মাষ্টার নিত্যানন্দ ভদ্রের মধ্যে অত্যধিক দেশপ্রেম লক্ষ্য করা যায়। দেশ তথা মাতৃভূমিকে খুব ভালবাসতেন বলে সুযোগ থাকা সত্বেও তিনি দেশ ত্যাগ করেননি। দেশের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও গভীর প্রেম ছিল বলেই তিনি বলতেন Ñ“মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ট।“
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ধার্মিক ও সৎ। তিনি ত্রিসন্ধ্যা ‘গায়ত্রী মন্ত্র“ জপসহ সকাল সন্ধ্যা ঈশ্বর-পুজা নিয়মিত করতেন। সন্ধ্যার পর প্রতিদিনই অধিক রাত পর্যন্ত শ্রাস্ত্র পাঠে গভীর মনোনিবেশ করতেন। তিনি স্বস্ত্রীক বাংলা-ভারতের অনেক তর্ীথক্ষেত্র পরিভ্রমন করেছেন। তীর্থ পর্যটন শেষে গৃহে ফিরে তিনি “নিরামিষ আহারে“ নিজেকে সর্মপন করেছিলেন প্রায় ২০বছর।
শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন সফল। কোনদিন বেশী ছুটি নিতেন না। স্কুলে নিয়মিত সঠিক সময়ে উপস্থিত হতেন। পাঠদান কাজে ছিল না কোন ফাকিঁ ও অবহেলা। না বুঝলে বার বার বুঝাতেন বিষয়টি,স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে ও পড়া না করে গেলে শাসন করতেন খুব এবং কখনও কখনও মারতেনও বটে। স্যারের একটা কমন গালি ছিল “গবেট ও নছ্ছার কথাটি“ যা আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের মনে আজও দাগ কেটে আছে। তারপর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭২ সালের ১৯ অক্টোবর অবসর গ্রহন করেন। অবসরের সময়টুকু তিনি বৃথা যেতে দেননি। জীবনের সেই আশা নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে সেই মাহেন্দ্রক্ষন ঘনিয়ে আসে। ১৯৯৮ সালের ২১ জুলাই রাত ১টা ১০ মিনিটের সময় সকলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ইহলীলা সম্ববরণ করে পরলোকে গমন করেছিলেন।(দহেয়ং সর্বগাত্রাণী দিব্যান্ লোকান্ স্ব গছ্বতুঃ)