মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার।। ঈশ্বরগঞ্জের নামকরণের বয়স প্রায় পৌনে দুই শত বছর। তবে ‘ঈশ্বরগঞ্জ’ থানাটি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো, তা ২য় পর্বে প্রকাশ করা পর ৩য় পর্বে পর্যাক্রমে ইতিহাসের কিছু তথা উপাদান সংগ্রহ করে ময়মনসিংহের গৌরীপুরস্থ এসিক এসোসিয়েশন (ACECC Association ), ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি এন্ড লাইব্রেরি এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে আসছে। সরেজমিন ও গবেষণার মাধ্যমে ঈশ্বরগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শেকড়সন্ধানী তথ্য ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোরের আমলে ঈশ্বরগঞ্জের উন্নয়নঃ বিশ্বেশ্বরী দেবীর দত্তক পুত্র গ্রহণের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারের সময়ে ব্রজেন্দ্র কিশোর জমিদারির দায়িত্ব নেয়ার মতো বয়স হলে সম্পত্তির বিভাগ বিভাজন নিয়ে বিশ্বেশ্বরী দেবীর সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারিবারিক বিবাদ নিরসন হয়। মা-পুত্রের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেল। ফলে গৌরীপুর জমিদারির সমস্ত সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ (৮০ গন্ডা) বিশ্বেশ্বরী দেবীর হাতে ছিল এবং অপর তিন চতুর্থাংশ ব্রজেন্দ্র কিশোর সম্পত্তির অধিকারী হলেন। দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণের দশ বছর পর ব্রজেন্দ্র কিশোর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে জমিদারির কার্যভার গ্রহণ করে অতি দক্ষতার সহিত কর্তব্য পালন করতে লাগলেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভাবলে অল্পদিনের মধ্যেই লোকসমাজে সুনাম অর্জন করেন। যশ, মান, সম্মানের সঙ্গে তাঁর সম্পত্তিরও উন্নতি হতে লাগলো। বিভিন্ন জায়গায় জমিদারি কিনে পৈত্রিক সম্পত্তির পরিধি বাড়িয়েছিলেন। হাট-বাজার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন করেছিলেন। পানি চলাচলের জন্য খাল কাটা, পতিত জমিতে প্রজা বসতি স্থাপন করে সম্পত্তির উন্নতি সাধন করেছিলেন। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ প্রথম খণ্ড থেকে জানা যায় যে, বিশ্বেশ্বরী দেবী আজীবন সততার সঙ্গে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ছিলেন শিক্ষিতা, মেধাবী, শিক্ষানুরাগী, ধার্মিক ও সমাজসেবক। এই গ্রন্থে বিশ্বেশ্বরীর তীর্থবাসের কথা উল্লেখ রয়েছে। তাই তিনি তীর্থস্থানে যাওয়ার আগে তাঁর সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ তাঁর ছেলে ব্রজেন্দ্র কিশোরের কাছে হস্তান্তর করেন এবং উক্ত সম্পদের অর্জিত ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তাঁর স্বামীর নামে দেশের সবচেয়ে সুন্দর একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলে যান। মা’র আদেশ পালন করে জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১০ জুলাই ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতা রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর নামানুসারে গৌরীপুরে ১১ একর জমিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তীর্থস্থানে বিশ্বেশ্বরী দেবীর মৃত্যুর পর জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তার মার নামে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা শহরের কাঁচামাটিয়া নদীর কোলে ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঈশ্বরগঞ্জ বিশ্বেশ্বরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। তাছাড়া তিনি ১ জানুয়ারি ১৯২০ খ্রিঃ তাঁর মাতার নামানুসারে সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে বিশ্বেশ্বরী মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। বিশ্বেশ্বরী দেবীর মৃত্যুর তথ্যটি ১৯১৭ সালে F. A. Sachse এর সম্পাদিত Bengal District Gazetteers’ Mymensingh প্রকাশের মাধ্যমে জানা যায়। (Page-157) Jugal Kishor’s share descended through an adopted grand¬ son to Rajendra Kishor, who again died childless. His widow Bisveswari Debi enjoyed a fourth of the estate (Gauripur 4 annas) as a separate estate until her death a short time ago. Her adopted son, Brajendra Kishor, who brought the wellknown swadeshi case against Mr. Clarke, the Collector of the district, in connection with the Jamalpur riots in 1907, is the sole proprietor of the second 4 annas share. সুতরাং দেখা যাচ্ছে ১৯১৭ সালে গেজেটিয়ার প্রকাশের দুই- তিন বছর আগে বিশ্বেশ্বরী দেবীর মৃত্যু হয়।
ঈশ্বরগঞ্জ, সোহাগী ও আঠারবাড়ী রেল স্টেশনঃ ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে তিনটি রেলওয়ে স্টেশন- ঈশ্বরগঞ্জ, সোহাগী ও আঠারবাড়ী। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির মাধ্যমে ১৮৮৫ সালে ময়মনসিংহের সঙ্গে ঢাকার রেল সংযোগ স্থাপন হয়। ১৮৯২ সালে ইংল্যান্ডে গঠিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি এদেশে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঈশ্বরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন, সোহাগী রেলওয়ে স্টেশন, আঠারবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন ১৯১২ থেকে ১৯১৮ সালে তৈরি করা হয় এবং ময়মনসিংহ- গৌরীপুর- ভৈরব লাইনের সাথে চালু হয়। ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব রেললাইন ছিল আসাম-বেঙ্গল রেল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাধীনে। ঈশ্বরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন, ঈশ্বরগঞ্জ শহরে অবস্থিত ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব রেলপথের একটি রেলওয়ে স্টেশন। এই রেলওয়ে স্টেশন হতে দক্ষিণ অবস্থিত বগাপোতা গ্রাম। ইতিহাস বলছে বগাপোতা কামরূপদের নামকরণ। বগাপোতা গ্রামটি এক সময়ে নদীর চর বা দ্বীপ ছিল। এই চরে অনেক বগা, বগলা অথবা বক পাখির বসবাস ছিল। কোন এক মহামারীতে অনেক পাখির মৃত্যু হলে এই চরে পাখিদের পোতে রাখা হয়েছিল তখন জায়গাটির নাম হয় বগাপোতা। গৌরীপুরের জমিদারদের অনুরোধে বগাপোতা গ্রামে সোহাগী রেলওয়ে স্টেশন তৈরি করা হয়। রেলওয়ে স্টেশনটির নামকরণ করা হয় বগাপোতা গ্রামের পাশ্ববর্তী গ্রাম সোহাগীর নাম দিয়ে । পরবর্তী সময়ে সোহাগী রেলওয়ে স্টেশন কেন্দ্র করে সোহাগী ইউনিয়ন পরিষদের নামকরণের সৃষ্টি হয়।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ঐতিহ্যঃ # নীলকুঠি – ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা গোল্লাজয়পুর গ্রামে নীলকুঠির ধ্বংশাবশেষ। পলাশী যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর কাছে বাংলার শেষ নবাবের পরাজয়ের পর পর ইংরেজরা দল বেঁধে এ অঞ্চলে আসতে থাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের আশায়। নবাব সিরাজের পতনের পর ঈশ্বরগঞ্জর মাদারগঞ্জের কাছে নীলকুঠি গোড়াপত্তন হয়। নীলকুঠি নীল বাণিজ্য ও ব্যবস্থাপনার জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্মাণ করেছিল। গৌরীপুরের সংগঠনগুলোর উদ্যোগে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে এই গ্রামে জরিপের সময় এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে নীলকুঠি বিষয়ে কথা হয়। গোল্লাজয়পুর গ্রামের কুঠিবাড়ী বাসিন্দা রোমান আহমেদ (২৭) বলেন, নীলকুঠির ধ্বংশাবশেষ মধ্যে বর্তমানে দালানের ভিটাটা রয়েছে। ভিটার নীচে এখনোও দুই তিনটি কক্ষ রয়েছে। অন্ধকার কক্ষে অনেক শিয়াল বা ইতর প্রাণী বসবাস করছে। এক সময়ে এটি দোতলা কাঠামো বিশিষ্ট লম্বা দালান ঘর ছিল।মোমেনসিং পরগণার সীমানা খোঁজার প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, গৌরীপুরের ১২টি জমিদার বাড়ির মধ্যে এখানে কালীপুর, ভবানীপুর, ও গৌরীপুর রাজবাড়ি জমিদারের রাজস্ব আদায়ের সীমানা রয়েছে। তাছাড়া নীলকুঠির থেকে ৭০/৮০ গজ দূরে রয়েছে চিত্রনাট্যকার ও কৌতুকাভিনেতা আশীষ কুমার লোহর জন্মস্থান ও বাবার বাড়ি।
# ভূইয়া বাজার মঠ- ভূইয়া বাজার মঠ নামে পরিচিত। বর্তমানে ঐ জায়গায় কোন হাট বাজার নেই। ঈশ্বরগঞ্জ শহর নিকটবর্তী এলাকা ও কাচামাটিয়া নদীর তীরে ঐ স্থানটি অবস্থিত। শুধু মঠটি ইতিহাসের পাতায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বীর পাঁচাশী গ্রামের বাসিন্দা মো আব্দুল খালেক বলেন, তিনি বাপ-দাদার কাছে শুনেছেন যে, এক সময়ে মঠের কাছে বাণিজ্যিক এলাকা এবং নদীবন্দর ছিল। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে মঠটি জরিপের সময় মঠের কাছে সরকারি জায়গায় বসবাসকারী ফুলজান(৭৮) বলেন ময়মনসিংহের বিশ্বজিৎ বাবু মাঝে মাঝে পূজার আয়োজন করে থাকেন এবং রবিদাস সম্প্রাদায় মঠটি দেখাশুনা করে থাকেন।
# খানপুর গ্রামে দুটি মঠ- সরিষা ইউনিয়নে খানপুর গ্রামে দুটি মঠ রয়েছে।
#আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি- নান্দাঈল উপজেলার সীমানা ঘেষাঁ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত কালের সাক্ষী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি। হোসেনশাহী পরগনার অংশে আঠারবাড়ী জমিদার বাড়িটির অবস্থান।
# দরগাপাড়া- হারুয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে দরগা পাড়া নামে পরিচিত মধ্যযুগের মাজার রয়েছে। # রাজীবপুর জমিদার বাড়ি– উচাখিলা হতে মধুপুর যাওয়ার পথে রাজীবপুর জমিদার বাড়িটি দেখতে পাওয়া যায়। # ধীতপুর সর্দারবাড়ি- মগটুলা ইউনিয়নের ধীতপুর গ্রামে একটি সর্দারবাড়ির (রাজবাড়ি) ধ্বংশাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
# মুঘল আমলের মসজিদ- খাজা উসমান খাঁ ও মুঘল আমলের বেশ কিছু প্রাচীন মসজিদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছ। যেমন ঈশ্বরগঞ্জ বড় মসজিদ, উচাখিলা প্রাচীন জামে মসজিদ, চরযিথর তিন গম্বুজ প্রাচীন জামে মসজিদ, জিগাতলা মুন্সিবাড়ি এক গম্বুজ প্রাচীন জামে মসজিদ, ভালুকবেড় উত্তর পাড়া এক গম্বুজ প্রাচীন জামে মসজিদ।
বিবিধ – ১৮৭৯-৮০ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ৫৪টি ডাকঘর ছিল। ১৯০৭ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহে ৩টি প্রধান ডাকঘর, ৪৬টি সাব অফিস ও ১৪৭ ব্রাঞ্চ অফিস ছিল। যেমন- ২য় শ্রেণীর হেড অফিস শ্যামগঞ্জ, শম্ভুগঞ্জ, ডৌহাখলা; সাব পোস্ট অফিস- ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, রামগোপালপুর। ১৮৮০ সালে ঈশ্বরগঞ্জে ডাকঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৮ সালে টেলিগ্রাম চালু হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ৭ অক্টোবর ঈশ্বরগঞ্জে পৌরসভা গঠিত হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ নভেম্বর ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।