নদীবেষ্টিত পটুয়াখালী পৌরসভায় বসবাসরত লক্ষাধিক মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভোগছেন। পৌর কর্তৃপক্ষের সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানির ওপরই নির্ভর করেন অধিকাংশ পৌরবাসী। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর কারণে এ অঞ্চলে প্রতিনিয়ত পানি সংকট বাড়ছে।
বর্তমানে পৌরসভার চারটি ওভারহেড ট্যাংক থেকে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বিভিন্ন এলাকায় সাপ্লাইয়ের পানিতে দুর্গন্ধ, শ্যাওলা ও লবণাক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকেই বলেন, এই পানি খাবার উপযোগী নয়; ফুটিয়ে বা ফিল্টার ব্যবহার করে পান করতে হয়।
পৌর এলাকার স্বনির্ভর রোডের বাসিন্দা আনু বেগম বলেন, “আমাদের এখানে সাবমারসিবল বসানো, তারপরও প্রথমে লবণ পানি ওঠে। চার-পাঁচ মিনিট পর খাবার উপযোগী পানি আসে। পৌরসভার সাপ্লাই পানি দিয়ে খাওয়া যায় না, কারণ তাতে অনেক সময় ময়লা ও দুর্গন্ধ থাকে।”
এদিকে রিকশাচালক ইব্রাহিম মিয়া বলেন, “পানি ঠিকমতো পাওয়া যায় না, বিশুদ্ধ পানি তো দূরের কথা। সাপ্লাইয়ের পানি খেলে অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ি। হোটেলগুলোও এই পানি ব্যবহার করে, কিন্তু তা নিরাপদ নয়।”
শুকনো মৌসুমে এ সংকট আরও তীব্র হয়। অনেক জায়গায় পাম্প থেকে প্রথম ৫- ১০ মিনিট পর্যন্ত অতিরিক্ত নোনতা পানি আসে, যা ব্যবহার অনুপযোগী। পানি সংগ্রহের স্থানগুলোও অধিকাংশ সময় অপরিচ্ছন্ন থাকে।অর্থবান পরিবারগুলো নিজস্ব সাবমারসিবল স্থাপন করে পানির ব্যবস্থা করলেও নিম্নআয়ের মানুষরা মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ঘূর্ণিঝড় বা জলাবদ্ধতার সময় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে—তখন পানি সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
পটুয়াখালীর সমাজ সেবক মোজাম্মেল নাসরিন এমা বলেন , এখনই পরিকল্পিত ও টেকসই সমাধান না হলে ভবিষ্যতে পটুয়াখালী পৌর এলাকায় জনস্বাস্থ্য সংকট দেখা দিতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পানিশোধন ব্যবস্থা, বিকল্প উৎস অনুসন্ধান এবং দীর্ঘমেয়াদি পানি ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সংকট নিরসনে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদ শামিম বলেন, যে কোন জায়গার দীর্ঘদিন ধরে যদি দূষিত ও লবণাক্ত পানি ব্যবহারে শিশুদের চর্মরোগ ও ডায়রিয়া বাড়ছে। পটুয়াখালীতে যে সকল শিশুরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসে তার মধ্যে অনেকেই দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে তারা অসুস্থ হচ্ছে।
পটুয়াখালী পৌরসভার পৌর প্রশাসক জুয়েল রানা বলেন, “গ্রাহকের তুলনায় পাম্পের সংখ্যা কম হওয়ায় সবাই পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না। আমরা প্রতি মাসে ওভারহেড ট্যাংক ও সঞ্চালন লাইনগুলো পরিষ্কার করি। তারপরও কিছু এলাকায় সমস্যা থেকে যাচ্ছে। পানিকে পানযোগ্য করতে পৌরবাসীকে ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে পানের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”
অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জেলার একুইফারগুলোতে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ হচ্ছে, ফলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে। এখানকার পানিতে লিগনিন ও ট্যানিন নামক উপাদান থাকায় তা কিছু সময় পর লালচে হয়ে যায়। এতে স্বাদ নষ্ট হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।”