লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল, শালিখা (মাগুরা)।
বছরের শীত মৌসুম আসলেই খেজুর গাছ কাটতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন গাছিরা। অগ্রহায়ন- পৌস থেকেশুরু হয়ে ফাল্গুন-চৈত্র পর্যন্ত রস সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে গাছিদের পরিবার গুলোতে।
এই পাঁচ-ছয় মাস খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা বিক্রি করতে নিরলস সময় পার করেন গাছিরা। সাথে রস দিয়ে তৈরি গুড়-পাটালি বিক্রির ধুম চলে সমানে। রসের মৌসুম আসলেই গাছিরা এক মৌসুমে লক্ষ থেকে লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। ফলে খেজুর গাছের মাধ্যমে একদিকে যেমন রসের গুড় পাটালির চাহিদা পূরণ হয় অপরদিকে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল হয়ে উঠে। তবে বর্তমানে শালিখার প্রত্যন্ত অ লে দিনে দিনেবিভিন্ন কারনে কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। গ্রামীণ সড়কে এখন আর আগের মতো খেজুর গাছের সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য চোখে পড়ে না।
এর ফলে নতুন প্রজন্মের শিশুরাও শীতের সকালের খেজুর গাছের রস, গুড় ও পিঠার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক নগরায়ন ও অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদের পাহাড়ের রাণী খ্যাত খেজুর গাছের সংখ্যা ও খেজুুেরর রস গুড় পাটালি। গাছ না থাকায় কমেছে গাছির সংখ্যাও।
কয়েক বছর আগেও হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটার হিড়িক পড়ত শালিখা উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। গ্রামের পথে-ঘাটে, নদী বা পুকুরপাড়ে, বড় রাস্তার দুথপাশে বা ক্ষেতের সীমানা ঘেঁষে শত শত গাছের মাথার নরম আংশ বিশেষভাবে কাটতেন গাছিরা। ১৫-১৬টি পাতা রেখে গাছের উপরিভাগের বাকলসহ অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিষ্কার করে গাছের অগ্রভাগে নল বসিয়ে মাটির পাতিল ঝুলিয়ে রস সংগ্রহ করা হতো। আড়াআড়িভাবে বাঁধা বাঁশের খণ্ডে দাঁড়িয়ে কোমরে ও গাছে রশি বেঁধে ধারালো দা দিয়ে গাছিদের গাছ কাটার দৃশ্য ছিল দেখার মতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই দৃশ্য এখন তেমন চোখে পড়ে না।
বেশ চড়া দামে ইটভাটার মালিকদের কাছে খেজুর গাছ বিক্রি করা, নতুন করে খেজুর গাছ রোপণ না করা এবং গ্রামীণ সড়কের সংস্কার কাজের কারণেও অনেক স্থানে খেজুর গাছ উজাড় হয়ে গেছে।
শালিখা উপজেলার শতখালী ইউনিয়নের সিংহেস্বরপাড়ার আব্দুল কুদ্দস বলেন, ৩০ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছি, আগে এক সময় তিন থেকে চার’শ গাছ কাটতাম কিন্তু এখন গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতি মৌসুমে ৫০ থেকে ৬০ টি গাছ কাটছি।
আব্দুল কুদ্দুস আরো বলেন, এখনো অধিকাংশ মানুষ সকাল হলে আমার বাড়িতে আসে খেজুর রস নেওয়ার জন্য। এক হাড়ি রস বিক্রি করি ৩০০ টাকা এবং এক কেজি পাটালি ও ঝোলগুড় বিক্রি করি ২শ থেকে ৫শ টাকা। তারপরও লোকজনের চাহিদা অনুসারে ঠিকমতো দিতে পারি না। গাছ বেশি হলে প্রতি মৌসুমে লক্ষ থেকে লক্ষাধিক টাকা আয় করা যায় বলে জানান আব্দুল কুদ্দুস।
আড়পাড়া ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের তাহাজ্জৎ কাজী বলেন, এক সময় অনেকগুলো গাছ কাটতাম। এখন ২০-৩০ টা মত গাছ কাটি। তা থেকে যে রস হয় তা সকালবেলা লোকজন বাড়ির উপর এসে নিয়ে যায়।
এব্যাপারে শ্বপন, শামসুল, সাধনসহ কয়েকজন গুড় ও পাটালি বিক্রেতার সাথে কথা হলে তারা জানান, খেজুরের রস পর্যাপ্ত না থাকায় এখন অধিকাংশ জায়গায় চিনি মিশ্রিত গুড়-পাটালি বিক্রি হয়।
খেজুর রসের অভাবে গ্রাম অঞ্চলের মহিলারা এখন রসের বদলে চিনি ও পানি মিশিয়ে ভিজা পিঠা তৈরি করছে বলে অনেকে বলেন।
শ্রী ইন্দ্রনীল এসোসিয়েটসের প্রধান সংগঠক মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ও গবেষক ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, খেজুর গাছ একটি প্রকৃতিবান্ধব বৃক্ষ । বিভিন্ন গাছ রোপন করার জন্য সরকার যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তার মধ্যে খেজুর গাছ রোপনের বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করাটা অতীব প্রয়োজন। কারণ খেজুর গাছ একদিকে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে অপরদিকে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে সেই রস দিয়ে বিভিন্ন মিষ্টি সামগ্রী তৈরি করা যায়।
শালিখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আলমগীর হোসেন বলেন, শালিখা উপজেলায় ২৬ হাজার খেজুর গাছ আছে। যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম তাই এই গাছের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করতে সবাইকে খেজুর গাছ বেশি বেশি রোপন করা প্রয়োজন এবং পাশাপাশি যে গাছগুলো আছে সেগুলো নির্বিচারে কর্তন না করে পরিচর্যা করা প্রয়োজন। তাহলেই খেজুর গাছের মাধ্যমে চাহিদা মাফিক রস, গুড় ও পাটালি পাওয়া সম্ভব হবে।