।। লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল।।
পৃথিবীর এই লীলাক্ষেত্রে যুগে যুগে কতো না ভাবুক শিল্পী, সাধকক,কবি, সাংবাদিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক আসে আর যায়। ‘জন্মালে মৃত্যু”এই চিরন্তন নীতি অবলম্বন করেই সাধারন মানুষ আত্মিক ও বৈষয়িক উন্নতির শীর্ষে আরোহনের জন্য কঠিন পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের ফলে পৌছে যায় উন্নতির শিখরে। সৃষ্টির আদি থেকেই এই ধারা অব্যাহত
আছে। আবহমান কাল থেকে বাংলায় যে সকল মহতী তাপসের জন্ম হয়েছে তার মধ্যে শালিখা থানার ভাবুক কবি মহেন্দ্রনাথ গোস্বামীর নাম উল্লেখ করা যায়।
মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী ১৯১২ সালে শালিখা থানার তালখড়ি ইউনিয়নের গোয়ালখালী গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম নিবারন গোস্বামী ও মাতার নাম পর্নবালা দেবী। পিতার ৫ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। মহেন্দ্রযোগ তিথিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলে পিতামাতা নাম রেখেছিলেন মহেন্দ্র। প্রতিবেশীরা ও গ্রামের
মানূূূূূুষ তাকে মহেন বলে ডাকতো। ছোটবেলা থেকেই মহেন্দ্রনাথের চিন্তাচেতনা,ভাবগাম্ভীর্য ও সহনশীলতার পরিচয় পেয়ে কাকা ক্ষেপাচাঁদ বিশ্বাস বলতেন মহেন্দ্র একজন ভাবক পুরুষ হবে। অবশেষে কাকার কথায় সত্যি হয়েছিল।
ছোটবেলা থেকেই মহেন্দ্রনাথ বৈঠকী গানের প্রতি বেশী আকৃষ্ট ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি অনেক মরমী কবি,শিল্পী,সাধকদের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। ছোটবেলায় তিনি একদিন মাঠে গরু চরাতে গিয়ে হারিয়ে যান। অনেক খোজাঁখুজিঁ করেও খোজ মেলেনি। যেদিন পাওয়া গেল তখন তাঁর বয়স ৩০। মাথায় লম্বা চুল,মুখে লম্বা দাড়িঁ,পরনে গেরুয়া বসন,হাতে একতারা ও ডুগি। আর সেদিন তিনি বাউল সমাজের একজন সেক্রেটারী রুপে আর্বিভুত হয়েছিলেন। বাউল সমাজের সেক্রেটারী হয়ে তিনি বিভিন্ন দেশ বিদেশে একতারা হাতে প্রতিটি আসরে
মারফতি,মুশির্দী,কবি,ভাব,জারী ভাটিয়ালীসহ অসংখ্য ভাব সংগীত পরিবেশন করেছেন।
এই ভাবুক কবি বাউল শিল্পী হিসাবে বাংলা ভারতের সর্বত্রই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন । তাঁর জীবদ্দশায় স্বরচিত অনেক গান বাংলাদেশ টেলিভিশন,ঢাকা ও খুলনা বেতারে পরিবেশিত হয়েছিল। তিনি প্রখ্যাত শিল্পী হিসাবে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার কর্ত্তক অনেক প্রশংসাপত্র পেয়েছিলেন।
মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী শিল্পী হিসাবে যেসব মনিষীদের সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্য ড .ধ্যানেশ নারায়ন চক্রবর্তী,বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম,পল্লী কবি জসীমউদ্দিন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.মনছুর উদ্দীন ও ড. লুৎফর রহমান। বাংলার পল্লী ভাটিয়ালী জগতের গানের রাজা বিজয় সরকারের সঙ্গেও অনেক আসরে গান করেছেন এই ভাবুক কবি মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী। তিনি নিজে বাউল গান ছাড়াও ভাসান গান,জারিগান ও মারফতিগান রচনা করে গেছেন। তাঁর রচিত অনেকগান এখনও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে গীত হয়ে থাকে।
একবার ভারতের শান্তিনিকেতনে গান করার সময় সাংবাদিকরা মহেন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছিলেন-আপনারা কেন এই গান করেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন –এই গান ও সুর আমাদের সাধনার অঙ্গ। গান ও সুরের মধ্যে আমরা ঈশ্বরের ভাবালেশ পাই তাই আমরা এই গান করি। পরবর্তীতে তিনি ‘গোস্বামী” উপাধীতে ভ’ষিত হয়েছিলেন। এই ভাবক কবি বাউল সাধক মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী যতোদিন বেচেঁ ছিলেন ততোদিন একতারা হাতে তিনি দেশ দেশান্তরে অসংখ্য গান পরিবেশন করে গেছেন। ইংরেজি ১৯৮৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সোমবার মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী তাঁর অসংখ্য ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে ৭৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
২০১২ সালের ৯,১০ও ১১ই মার্চ খাজুরা এম এন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে “গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র“ আয়োজিত গ্রামীন জীবনযাত্রা ও কৃষি প্রযুক্তি তথ্য,বীজ মেলার অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে দেশ তথা অত্র অঞ্চলের ৩০ জন গুনীজনের সম্মাননা প্রদান করা হয়। মরনোত্তর গুনীজন সম্মাননার মধ্যে এই বাউল সাধক কবি ও শিল্পী মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী ছিলেন অন্যতম একজন।