ভারত সীমান্তঘেঁষা বালিয়াদিঘির আম্রকাননে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টির ভগ্ন কাঠামো। বিস্ময়কর হলেও সত্য, নিভৃত এই গ্রামেই একদা জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, যা দারাসবাড়ি মাদ্রাসা নামেও পরিচিত। তবে পরিচর্যার অভাবে ঐতিহাসিক এই নিদর্শনটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আনুমানিক ১৪৭৯ সালে সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের শাসনামলে এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা একটি শিলালিপির মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, সুলতানের আদেশেই মাদ্রাসা ও সংলগ্ন মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তীতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের আমলে এটির সংস্কার হয় এবং ধারণা করা হয়, ১৫০২ সালে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগারও ছিল।
স্থানীয়দের বিশ্বাস, ‘দারস’ অর্থাৎ পাঠদান থেকেই এই স্থানের নাম হয় দারাসবাড়ি। ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদ ও কোতোয়ালি দরজার মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই একসময় এই অঞ্চল আধুনিক মুসলিম সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই রয়েছে দারাসবাড়ি মসজিদ, যা এখনও তার পূর্ণরূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করছেন, এটি একটি বর্গাকার ভবন ছিল, যার প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৫৫.৫ মিটার। দক্ষিণে মূল ফটক এবং উত্তর ও পূর্বে আরও দুটি প্রবেশপথ ছিল। ভবনের মাঝে ছিল একটি খোলা চত্বর এবং কেন্দ্রে অধ্যক্ষের কক্ষ ও সম্ভবত একটি গ্রন্থাগার। মাদ্রাসার চারপাশে ৩৭টি ছোট-বড় কক্ষ ছিল। পোড়ামাটির ইটের তৈরি দেওয়ালে কারুকার্য খচিত ছিল।
তবে সুলতানি আমলের পতনের পর নানা কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গুরুত্ব হারাতে থাকে। আর্থিক সংকট এবং সম্ভবত কোনো ভূমিকম্পের কারণে এটি মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে খননকার্য চালিয়ে পুরনো কাঠামোর ভিত্তি উদ্ধার করা সম্ভব হলেও, উপরের অংশটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করা সত্ত্বেও, সীমান্ত proximityর কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সংরক্ষণ ও আধুনিকীকরণ করা যাচ্ছে না। সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে স্থায়ী কাঠামো নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা থাকায় সরকারের পক্ষে এখানে কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে অবস্থিত দারাসবাড়ি মসজিদ এখনও তার স্থাপত্যশৈলীর জানান দেয়। ছয়টি গম্বুজ ও অখণ্ড পাথরের স্তম্ভ বিশিষ্ট এই মসজিদের দেওয়ালগুলিও বেশ প্রশস্ত। মহিলাদের নামাজের জন্য এখানে আলাদা স্থান ছিল।
রাজশাহী থেকে আগত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তারেক সালমান আক্ষেপ করে বলেন, পরিচর্যার অভাবে এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন দুটি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে এবং এগুলির রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।