আশুরা, ইসলামিক ক্যালেন্ডারের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিন, যা মুসলিম বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধাবোধ এবং নানা ঐতিহাসিক স্মৃতির জন্ম দেয়। হিজরি সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশম দিনে পালিত হয় এই দিনটি। “আশুরা” শব্দটি আরবি ‘আশারুন’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘দশম’।
এর নামকরণের পেছনে রয়েছে মুহাররম মাসের দশম দিনের বিশেষত্ব। কিন্তু এই দশম দিনটি কেবল একটি তারিখ নয়, এটি যুগ যুগ ধরে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী, যা এই দিনটিকে দিয়েছে এক অনন্য মর্যাদা।
আশুরা শুধুমাত্র একটি সাধারণ দিন নয়, এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং ধর্মীয় তাৎপর্য এটিকে অনন্য করে তুলেছে। ইসলামের ইতিহাসে বেশ কিছু যুগান্তকারী ঘটনা এই দিনেই ঘটেছিল, যা এটিকে মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশেষ করে তোলে। এই দিনটি একদিকে যেমন শোক ও ত্যাগের প্রতীক, তেমনি অন্যদিকে মুক্তি ও বিজয়ের স্মারক।
আশুরার দিনটি ইসলামের ইতিহাসে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতি বহন করে:
১. কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা: আশুরার দিনের সবচেয়ে পরিচিত এবং হৃদয়বিদারক ঘটনাটি হলো ৬১ হিজরিতে (৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ) কারবালার প্রান্তরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইয়াজিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তিনি সপরিবারে নির্মমভাবে শহীদ হন। এই ঘটনা মুসলিম উম্মাহকে ত্যাগ, ধৈর্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগায়। শিয়া মুসলিমদের কাছে এটি প্রধান শোক দিবস।
২. ফেরাউনের কবল থেকে মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মুক্তি: হাদিস অনুযায়ী, এই দিনে আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা (আ.) এবং তার অনুসারী বনি ইসরাইলকে ফেরাউন ও তার বাহিনীর কবল থেকে লোহিত সাগর বিভক্ত করে রক্ষা করেছিলেন। ফেরাউন তার বিশাল বাহিনী নিয়ে সাগরে ডুবে গিয়েছিল। এই ঘটনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে মুসা (আ.) এই দিনে রোজা রেখেছিলেন, যা পরবর্তীতে মুসলিমদের জন্য একটি সুন্নত হিসেবে প্রচলিত হয়।
৩. নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি: এই দিনে হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি পেয়েছিল এবং জودي পর্বতে নোঙর ফেলেছিল।
৪. অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আশুরার ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামিক বর্ণনা অনুযায়ী, আশুরার দিন আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
ইসলামে আশুরার দিন রোজা রাখার বিশেষ ফযিলত রয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় এসে যখন দেখতে পান ইহুদিরা এই দিনে রোজা রাখে, তখন তিনি এর কারণ জানতে চাইলে তারা মূসা (আ.)-এর মুক্তির কথা বলেন। তখন নবী করিম (সা.) বলেন, “আমরা মূসার ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার।” এরপর তিনি আশুরার দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দেন।
আশুরার রোজার ফযিলত: হাদিসে এসেছে, আশুরার দিনের রোজার মাধ্যমে আল্লাহ বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। এই ফযিলত বহু মুসলিমকে এই দিনে রোজা রাখতে উৎসাহিত করে।
রোজা রাখার সঠিক পদ্ধতি: ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য পরিহার করতে এবং রোজার ফযিলত পূর্ণ করতে মহানবী (সা.) শুধুমাত্র দশম তারিখের সঙ্গে নবম বা একাদশ তারিখের রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ, মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখা সুন্নত। শুধুমাত্র ১০ তারিখ রোজা রাখা মাকরূহ বা অনুচিত।
রোজা রাখা ছাড়াও এই দিনে নফল ইবাদত-বন্দেগি, দান-সদকা করা, আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং বেশি বেশি জিকির-আজগার করা যেতে পারে। তবে আশুরার দিনে দোয়া কবুলের বিশেষ কোনো স্বতন্ত্র ফযিলতের কথা সরাসরি নির্ভরযোগ্য হাদিসে উল্লেখ নেই, বরং যেকোনো সময় আন্তরিকভাবে দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন।
আশুরা পালন পদ্ধতিতে শিয়া ও সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে, যা তাদের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিন্নতা থেকে উদ্ভূত:
আশুরার দিনে প্রচলিত কিছু প্রথা বা কার্যক্রম নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে এবং কিছু কুসংস্কারও দেখা যায়:
আশুরা মুসলিমদের জন্য শোক, ত্যাগ, ধৈর্য এবং ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার এক মহান শিক্ষা নিয়ে আসে। এই দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্যের জন্য লড়াই করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই দিনটিকে পালনের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও সহিহ সুন্নাহ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি মুসলিমের উচিত নির্ভরযোগ্য ইসলামিক উৎস থেকে আশুরার প্রকৃত তাৎপর্য জেনে সে অনুযায়ী আমল করা এবং সকল প্রকার বাড়াবাড়ি ও কুসংস্কার থেকে বিরত থাকা।