ট্রেনে বিনা টিকিটে চড়া তিনজনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমার আত্মীয়; এটা এখন ঠিক, যেটা আমিও এখন শুনেছি। এর আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না, এরা কারা এবং আমার জানার কথাও না। মাত্র ৯ মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে।’
এক দিন আগেই যাদের চেনেন না দাবি করেছিলেন, বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়া সেই তিন যাত্রীকেই আত্মীয় বলে স্বীকার করে নিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন।
মন্ত্রণালয়ে রোববার সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি।
ওই তিন যাত্রীকে জরিমানা করায় বরখাস্ত হয়েছেন ট্রাভেলিং টিকিট এক্সামিনার (টিটিই) শফিকুল ইসলাম। তাকে বরখাস্ত করতে মন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আকতার মনি নির্দেশ দেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। মন্ত্রী বলছেন, তিনিও বিষয়টি শুনেছেন।
ট্রেনে বিনা টিকিটে চড়া তিনজনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার আত্মীয়; এটা এখন ঠিক, যেটা আমিও এখন শুনেছি। এর আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না, এরা কারা এবং আমার জানার কথাও না।’
তিনি বলেন, ‘মাত্র ৯ মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে। নতুন যে স্ত্রীকে আমি গ্রহণ করেছি, সে ঢাকাতেই থাকে। তার মামাবাড়ির- নানাবাড়ি হলো…।’
স্ত্রীর ফোনে টিটিই বরখাস্ত হওয়ার বিষয়টি শুনেছেন কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা যেভাবে শুনেছেন, বিষয়টি আমিও সেভাবে শুনেছি।’
এর আগে শনিবার মন্ত্রী সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, ট্রেনের ওই তিন যাত্রীর সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। তাদের তিনি চেনেনও না। সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণেই বরখাস্ত হয়েছেন টিটিই।
তবে গনমাধ্যমের প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে, আলোচিত তিন যাত্রীই রেলমন্ত্রীর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। মন্ত্রীর পরিচয় ব্যবহার করেই তারা বৃহস্পতিবার রাতে ঈশ্বরদী থেকে আন্তনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে উঠেছিলেন।
ট্রেনে নিয়মিত চেকিংয়ের সময় কর্তব্যরত টিটিই শফিকুল ইসলাম তাদের টিকিট দেখতে চান। শফিকুলের অভিযোগ, টিকিট নেই জানিয়ে তারা নিজেদের রেলমন্ত্রীর আত্মীয় বলে পরিচয় দেন।
এ অবস্থায় বিষয়টি পাকশী বিভাগীয় রেলের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (এসিও) মো. নুরুল আলমের সঙ্গে কথা বলে রেলমন্ত্রীর আত্মীয়দের সর্বনিম্ন ভাড়া দিয়ে টিকিট কাটার পরামর্শ দেন টিটিই। তিনি ওই তিন যাত্রীকে এসি টিকিটের পরিবর্তে মোট ১ হাজার ৫০ টাকা নিয়ে জরিমানাসহ সুলভ শ্রেণির নন-এসি কোচে সাধারণ আসনের টিকিট করে দেন। এ সময় ট্রেনে কর্তব্যরত অ্যাটেনডেন্টসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেল কর্মকর্তা জানান, ওই তিন যাত্রী তাৎক্ষণিকভাবে লিখিত কোনো অভিযোগ না দিলেও ঢাকায় পৌঁছে তারা রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগ পেয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিন সংশ্লিষ্ট টিটিইকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেন।
আলোচিত তিন যাত্রীর নাম ও পরিচয় জানতে পেরেছে বিডিটেলিগ্রাফ। তারা হলেন ইমরুল কায়েস প্রান্ত, ওমর এবং হাসান। এদের মধ্যে ইমরুল কায়েস টিটিই শফিকুলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের একটি অনুলিপিও পেয়েছে বিডিটেলিগ্রাফ।
লিখিত সেই অভিযোগে প্রান্ত স্বীকার করেন, তিনি ও তার ছোট দুই মামা বিনা টিকিটে সুন্দরবন এক্সপ্রেসে চড়েছিলেন। কাউন্টার থেকে টিকিট না পাওয়ার কারণেই তারা এভাবে ট্রেনে চড়েন।
অভিযোগে প্রান্তর দাবি, ট্রেন ছাড়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে টিটিই এসে টিকিট চান। তখন টিটিই শফিকুল তাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে ১ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করেন। প্রান্তরা টিকিট দাবি করলে শফিকুল তাদের উচ্চস্বরে গালিগালাজ করেন।
শফিকুল ইসলাম ‘মাদকাসক্তের মতো আচরণ করছিলেন’ অভিযোগ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয় লিখিত অভিযোগপত্রে।
তবে বিভিন্ন গনমাধ্যমের অনুসন্ধানে প্রান্তর রেলমন্ত্রীর পরিচয় ব্যবহার করে ট্রেনে ভ্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের শ্বশুড়বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে। সেখান থেকেই বৃহস্পতিবার প্রান্ত ও তার দুই মামা ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। তিনি রাজধানীর বাড্ডার একটি টেক্সটাইল কোম্পানিতে চাকরি করেন।
প্রান্তর মা ইয়াসমিন আক্তার নিপা গনমাধ্যমকে জানান, রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আকতার মনি তার ফুপাতো বোন। সে হিসাবে প্রান্ত রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের ভাগনে। আর বৃহস্পতিবার প্রান্তর সঙ্গে রেলযাত্রায় অংশ নেন মন্ত্রীর ছোট মামাশ্বশুর জাহাঙ্গীর আলমের দুই ছেলে হাসান ও ওমর।
ঈশ্বরদীর নুর মহল্লার কর্মকারপাড়ায় জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ছিলেন রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মি আকতার। পাবনায় এলে তিনি এই বাড়িতে ওঠেন। ওই বাড়ির আরেকটি অংশে থাকে প্রান্তর পরিবার।
প্রান্তর মা ইয়াসমিন আক্তার নিপা গনমাধ্যমকে বলেন, ‘রেলমন্ত্রীর ওয়াইফ আমার বোন হয়। আমরা ফুপাতো বোন। আমার এখানেই তো সে ঈদ করে গেল।’
প্রান্তসহ তিনজনের ট্রেনে চড়ার আগে মন্ত্রীর স্ত্রী ট্রেনের লোকজনকে বিষয়টি অবহিত করেছিলেন বলে জানান নিপা। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের ওয়াইফ গার্ডকে ফোন দিয়ে বলছে, আমার বাচ্চারা গেল, ঠিকঠাকভাবে নামায়ে দিয়েন। এখন তো কেবিন খালি যাচ্ছিল। তাই উনি (গার্ড) কেবিনে নিয়ে ওদের বসায় দিছে, যে রেলের রিলেটিভ, একটু আরামেই যাক।’
মন্ত্রীর স্ত্রী কাকে বলে দিয়েছেন জানতে চাইলে নিপা বলেন, ‘পরিচিত গার্ড ছিল উনাকে বলছে। তো গার্ড কেবিনে বসায় দিছে। ওই মুহূর্তে টিটিই গিয়ে বলছে, রেলের রিলেটিভ হও আর যাই হও, বাপের তো গাড়ি না। উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। তখন আমার ছেলে আমাকে ফোন দিছে। আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম, আর উনি (রেলমন্ত্রীর স্ত্রী) পাশেই ঘুমাচ্ছিল। আমি তখন উনাকে বললাম, শাম্মি তাড়াতাড়ি দেখ তো…।
‘তখন উনি ফোন করে রাগ হয়ে গেছে। আমি বললাম, আমার কথার উপর দিয়ে টিটিই এমন বিহেভ করবে কেন?’
নিপা দাবি করছেন তার ছেলেসহ তিন আত্মীয় টিকিট কেটেই ট্রেনে চড়েছিলেন। তবে প্রান্তর লিখিত অভিযোগে দেখা গেছে, তারা কেউ সেদিন টিকিট কাটেননি।
তিনি বলেন, ‘আমি অফিসের জরুরি কাজের জন্য ঢাকায় ফিরতে সেদিন রাত ২টায় বের হই। স্টেশনে টিকিট কাটতে যাই। তখন সেখান থেকে বলে টিকিট নেই। আমার সঙ্গে ছিল দুই ছোট মামা হাসান ও ওমর।
প্রান্ত দাবি করেন, তারা ট্রেনে উঠে মাঝামাঝি নন-এসি একটি বগিতে বসেন। কিছুক্ষণ ট্রেন উল্লাহপাড়ার কাছাকাছি পৌঁছালে টিটিই আসেন।
প্রান্ত বলেন, ‘ঈদের সময় ট্রেনে অনেক ভিড়। টিটিই বলেন কোথায় যাবেন? আমি বলি ঢাকায় যাব। টিটিই বলেন টিকিট করছেন? তখন আমি বলি, সিট পাইনি আর স্টেশনে টিকিট নিতে গিয়ে দেখি ট্রেন ঢুকে গেছে। তাই তাড়াহুড়া করে ট্রেনে উঠে গেছি। টিকিট নেয়া হয়নি। এ কথা বলার পর উনি (টিটিই) বলেন, আপনারা জরিমানাসহ ৫০০ টাকা করে দেন প্রতিজন।’
টিটিইকে মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়েছিলেন জানতে চাইলে প্রাপ্ত বলেন, ‘না… না। আমি কখনও কোথাও রেফারেন্স দিয়ে চলাচল করি না।’
তাহলে টিটিই কীভাবে মন্ত্রীর সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার পরিচয় জানলেন, এমন প্রশ্নে প্রান্ত বলেন, ‘আত্মীয় হওয়ার বিষয়টি পরবর্তীতে কীভাবে কী হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। এ ধরনের কোনো কথাই আসেনি।’
মন্ত্রীর স্ত্রী ট্রেনের গার্ডকে তাদের যাত্রার কথা জানিয়েছিলেন- প্রান্তর মায়ের এমন তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রান্ত পরিষ্কার কোনো জবাব দিতে পারেননি। শুরুতে টিকিট না কেটে ট্রেনে চড়ার তথ্য স্বীকার করলেও পরে তিনি দাবি করেন, স্ট্যান্ডিং টিকিট কেটেছিলেন।