।। মোঃ মাসুম বিল্লাহ ।।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান । আর এ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান যার উপরে অবতীর্ণ হয় তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম । রাসুল্লাহ (সঃ) এর জীবনদশায় আমাদের সকল প্রকার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্য দিয়েই আমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
আবূ হুরাইরা বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি তোমরা যতদিন আঁকড়ে ধরবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল এক আল্লাহ কিতাব (কুরআন) ও দুই রাসূলের সুন্নাহ (হাদিস)। মানুষ জাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের বাণী আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অবতীর্ণ করতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সে সম্পর্কে নির্দেশনা দিতেন। কুরআন অবতীর্ণ শেষ হলেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম এর নবুয়তের দায়িত্ব শেষ হয় । নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জীবন দশায় আমাদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি দাওয়াত দিয়েছেন এক ইসলামের, এক আল্লাহর এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসালাম আল্লাহর আনুগত্য অনুসরণের জন্য পথ বলে গিয়েছেন। সেখানে ইসলামের পথ ও রাসুলের পথ একটা। আলাদা কোনো মত বা পথ তিনি সৃষ্টি করে যাননি। কিন্তু আমরা দেখি বর্তমান সময়ে বিভিন্নমতের সৃষ্টি হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরে অনেক ব্যক্তিবর্গ তারা ইসলামী সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য গবেষণা কর্মে লিপ্ত হয়েছেন। ঠিক তেমনি আমাদের প্রসিদ্ধ এই চার ইমাম ইসলামের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছেন। আমরা দেখি ইমামগণ কখনো তারা নিজস্ব মত বা পথ সৃষ্টি করেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পথ এবং মতকে তারা অনুসরণ করে চলতেন। আর আমরা এসে সে রাসুল (সাঃ) এর পথকে অনুসরণ করতে গিয়ে ইমামদের পথকে মত হিসেবে গ্রহণ করেছি। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল কিন্তু আমরা কেউ কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর আনুগত্য প্রদর্শনের ভিত্তি হিসেবে এই ইমামদের অনুসরণ করতে গিয়ে তাদের মতকে একমাত্র পথ হিসেবে অবলম্বন করেছি।
যখন আমরা একটা নির্দিষ্ট ইমামের অনুসারী তখন আমরা অন্য ইমামকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। কেননা আমরা মনে করেছি যে নিজের পছন্দের নির্দিষ্ট পন্থা সঠিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেটা সৃষ্টি করে যাননি সেই কাজটি আমরা করেছি। আমরা রাসুলকে অনুকরণ না করে আমরা ইমামকে অনুকরণ করতে গিয়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।
আমরা মুসলমানরা ইসলাম অনুসরণ করার ক্ষেত্রে চার ধরণের পথ তৈরি করে এক অনুসারির লোক অন্য অনুসারির সহীহ তরিকার অবলম্বন করাটাকে হারাম ফতোয়া দিলাম। আাসলে যা রাসুল কখনো করেননি। আমরা যারা শুনে মুসলমান তারা পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া মত ও পথকে জাহির করতে বেশি ব্যস্ত। কিন্তু আমরা প্রতিকুলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে বেলাল (রাঃ) মতো মর্মে ধারণ করা মুসলমান হলে এমন ভাবে ইসলামকে বিচার করতে পারতাম না।
ধরুন আপনি হিন্দুর ঘরে জন্ম নিলে, তাহলে কি আপনি ছোটবেলা থেকে ইসলামের গুনগান করবেন? নাকি হিন্দুধর্মের? আপনি নিশ্চয়ই বাপ দাদার ধর্মের অনুসারণ রীতি মেনে চলবেন। কিন্তু কতজন মানুষ বুঝে পরিবর্তন হবে। সংখ্যাটা কম। প্রচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রসারে বিরাট ভুমিকা রাখে।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ এমনি মুসলমান তাই সহজে একজন অন্য জনের মতকে খারিজ করে দিতে পারে। ধরুণ আপনি ঢাকা যাবেন, বাড়ি আপনার মাদারীপুর। এখন প্রশ্ন হল আপনি কোন পথে যাবেন? পথ দুটি। এক পদ্মা সেতু পার হয়ে। দুই মাদারীপুর থেকে গোপালগঞ্জ, তারপার খুলনা, যশোর, মাগুরা রোডে দৌলতদিয়া ঘাট পার হয়ে সাভারের পরে ঢাকা। নিশ্চয়ই দুই নং পথে যাওয়া আপনার জন্য বোকামি। তবু যাওয়া তো যাবে ঢাকা। এখন এখানে আপনি কি বলতে পারেন কোনটা সহীহ আর কোনটা গালাত। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে পথ এক নং. সহীহ দুই নং. গালাত। কিন্তু ভ্রমণ পিপাসু মানুষের উদ্দেশ্য যদি হয় ষাটগম্বুজ পরিদর্শন, খুলনা ভ্রমন, মুজিনগর দেখা ফেরিতে উঠা আর সাভারে আত্মীয় বাড়ি ভ্রমণ তবে দুই নং পথ তার জন্য সঠিক।আল্লাহ ও রাসুল কে মানার ক্ষেত্রে বিশ্বাস বড় সেখানে যুক্তি আপনাকে ইবলিশের মতো অহংকারী করে তুলবে। আল্লাহ অহংকারীকে পছন্দ করেন না। কেননা অহংকার একমাত্র আল্লাহর ভুষণ। আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আপনি যে কোন পথে গেলে চলবে না বরং আল্লাহ র্নিদেশিত পথে চলতে হবে। ইবলিশ এতো বেশি ইবাদত করেছে যে, তার সিজদাহসমূহ পাশাপাশি করলে জমীনের এমন কোন স্থান পাওয়া যাবে না যেখানে তার সিজদাহ নেই। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে একটা সিজদাহ করেনি বলে তার সকল ইবাদাত নষ্ট হয়ে গেল। সুতারং সিজদাহ করা বড় কথা নয়
বরং আল্লাহ র্নিদেশ পালন করে সিজদাহ করা বড় কথা। আর আল্লাহর আল্লাহ র্নিদেশ পালনের জন্য সাধারণ মানুষ মাজহাবের উপর র্নিভরশীল। কিন্তু সমস্যা হল এক জনকে মানতে গিয়ে অন্য জনকে অস্বীকার করা নিয়ে।
ধরেন আপনি আওয়ামী লীগ করেন। সুতারং ১৫ আগস্ট আপনার জন্য শোক পালন করা বাঞ্ছনীয় আবার বিএনপি করলে জিয়াউর রহমান এর মৃতু বার্ষিকী। সাধারণত একদলের লোক হয়ে অন্যদলের অনুষ্ঠানে কেউ যায় না, তাহলে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়। আচ্ছা দল বড় না দেশ। আপনি মানুষ হলে দেশ তার পরে দল। কিন্তু দলকানা হয়ে যদি জিদের কারণে মুখে দেশ আর কাজে দলের জন্য করেন তবে আপনি ভন্ড। তাছাড়া দেশপ্রেমিক মাত্র যে কোন কিছুর এমন কি নিজের জীবনের আগে দেশের স্বার্থ দেখবে। ১৯৭১ তার প্রমাণ একই প্রমাণ ২০২৪। আর যারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক তারা ৭১ ও ২৪ দুটোকে স্বীকার করবে। কেননা ৭১ এ শেখ সাহেব ও জিয়াউর রহমানের অবদান প্রশংসনীয়। স্বাধীনতা পরবর্তীতেও জিয়াউর রহমান দেশের কল্যাণে কাজ করেছেন। তাই দুইজনকে বাংলার ইতিহাস বীরের মর্যাদা দিয়ছে। এখন আপনি যদি একটা দলের প্রতি অনুরক্ত হয়ে আর একজনকে অস্বীকার করেন তবে তা আপনার দেশ প্রেমের স্ববিরোধিতা করে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক দুজনের অবদানকে স্বীকার করবে। আর উদ্দেশ্য দিকে তাকালে দেখা যাবে দুই জন্য দেশের কল্যাণে কাজ করে দেশকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এখানে কারো অবদান কম বেশি হতে পারে, কিছুটা ভুলও হতে পারে। তাই বলে একজনকে মানতে গিয়ে অন্য জনকে নিষিদ্ধ করা কতটুকু সমীচীন?
ইসলামকে এভাবে বিচারের সুযোগ নেই। তবু যারা দীন ইসলামকে মাজহাব দিয়ে বিচার করেন আসুন আমরা দেখার চেস্টা করি এক্ষেত্রে মাজহাবের উৎপত্তি, কারণ, ইতিহাস ও তাদের মতামত আলোচনা করি।
মাযহাব হল ইসলামী ফিকহ বা আইনশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত এক একটি চিন্তাগোষ্ঠী ও চর্চাকেন্দ্র। নবী মুহাম্মদ (স.)-এর ইসলাম প্রচারের পর আনুমানিক প্রায় দেড়শত বছরের মধ্যে অনেক মাযহাবের উৎপত্তি হয়। সাহাবাদের মধ্যেও অনেকেই নিজস্ব মাযহাব প্রতিষ্ঠার জন্য কৃতিত্বের অধিকারী হয়ে আছেন। অবশেষে সাম্প্রতিক শতকে মোট আটটি প্রধান মাযহাবকে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় কর্তৃক সার্বিকভাবে গড় হিসাব অনুযায়ী পালনযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। মাযহাব শব্দটি বাংলায় মাজহাব, মজহাব, ইত্যাদি বানানেও প্রচলিত। ২০০৪ সালের ৯ই নভেম্বর জর্দানের আম্মানে অনুষ্ঠিত আম্মান বার্তা সম্মেলনে বিশ্বের ৫০ টি দেশের ২০০ জন মুসলিম আলেমের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত আটটি মাযহাবকে বর্তমান সময়ের জন্য পালনীয় হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। সেগুলো হলোঃ–
১. হানাফী ( সুন্নি ) ২. মালিকি ( সুন্নি ) ৩. শাফিয়ি ( সুন্নি ) ৪.হাম্বলী ( সুন্নি ) ৫. জাহিরি ( সুন্নি ) ৬. জাফরি ( ইসনা আশারি – ইসমাইলি শিয়া ) ৭. যায়দী ( শিয়া ) ৮.খারেজি: ইবাদি ( খারেজি )
চারটি প্রাথমিক সুন্নি মাযহাব হচ্ছে- হানাফী, শাফিঈ, মালেকী এবং হাম্বলি।
হানাফী ঃ মাযহাবটি ইমাম আবু হানিফার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার জন্ম ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ (৮০ হিজরি) ও মৃত্যু ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে (১৫০ হিজরি )। মাযহাবটি লেভান্ট, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, বেশিরভাগ মিশর,ইরাক, তুরস্ক ,বালকান এবং রাশিয়ার বেশিরভাগ মুসলিম সম্প্রদায়ের মুসলমানরা চর্চা করে থাকেন। এই মাযহাবের মধ্যে বেরেলভি ও দেওবন্দীদের মত বিপরীত মুখী আন্দোলনও অন্তর্ভুক্ত।
মালেকী ঃ মাযহাবটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মালিক ইবনে আনাস । উত্তর আফ্রিকা,পশ্চিম আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, সৌদি আরবের কিছু অংশ এবং উচ্চ মিশরের মুসলমানরা এ মাযহাব এর অনুসারী। অতীতে, ইসলামী শাসনের অধীনে ইউরোপের কিছু অংশে, বিশেষত ইসলামী স্পেন এবং সিসিলির আমিরাত এর অনুসরণ করা হয়েছিল।
শাফিঈ ঃ মাযহাবটি মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আশ-শাফিঈ প্রতিষ্ঠা করেন। সৌদি আরব, পূর্ব নিম্ন মিশর ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জর্ডান, প্যালেস্টাইন, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, সোমালিয়া, থাইল্যান্ড, ইয়েমেন, কুর্দিস্তান এবং কেরালার ম্যাপিলাস এবং ভারতের কোঙ্কানি মুসলমানরা এই মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। এটি ব্রুনাই এবং মালয়েশিয়া র সরকারি মাযহাব হিসাবে গৃহীত।
হাম্বলীঃ মাযহাব প্রতিষ্ঠা লাভ করে আহমদ বিন হাম্বলের হাত ধরে। কাতারের মুসলমানরা, সৌদি আরবের বেশিরভাগ এবং সিরিয়া ও ইরাকের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এ মাজহাবের অনুসারী।
আপনি কোন দলের লোক, ইসলামের অনুসারি? নাকি আবু হানিফার অনুসারি? নাকি মালেকী,শাফিঈ, হাম্বলি বা অন্যান্য দলের? প্রসিদ্ধ চার আলেমের দ্বীনের প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের সৌন্দর্য আরো সহজতর করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। একই সাথে বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান। সম্মানিত এসকল ইমামগণ নিজেদের ফতোয়া নিয়ে কখনো অহমিকা দেখাননি। বরং প্রত্যেক ইমামগন বলেছেন, আমার কোন ফতোয়া যদি আল্লাহ ও তার রসূল এর বিরুদ্ধে যায় তবে সে ফতোয়া ছুড়ে ফেলতে বলেছেন। চার ইমামের কাজ ছিল দ্বীনকে আরো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা। কিন্তু আমাদের মতো হুজুগে মানুষ তাদের পথকে দ্বীন ভাবতে শুরু করলাম। প্রত্যেকে ইসলামের সেবক নাভেবে আমরা তার অননুসরণ করে নিজের পছন্দের ইমামকে শ্রেষ্ঠ আর অন্যদের পথ অবলম্বন ভুল প্রচার করতে শুরু করলাম। ইহুদীরা ৭১ দলে আর নাসারা ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। (তিরিমিযী, ইবনে মাজাহ) একটি ব্যতীত সবই
জাহান্নামে যাবে। এখানে উম্মত বলতে শুধু মুসলমানদের বুঝানো হয়েছে।
মাজহাবের উৎপত্তি চার খলিফার মৃত্যুর পরে। রাসুল বেঁচে থাকতে সকল সমস্যার সমাধান দিতেন। কুরআনের সুস্পষ্ট বাণী, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পছন্দ করলাম (সূরা আল মায়েদা:৩)। এ কথার পরে নতুন করে ইসলামের নামে কিছু ঢুকানো অবান্তর। কিন্তু রাসুল ও খলিফাদের মৃত্যুর পরে সাধারণ মানুষের দ্বীন ইসলামের অজ্ঞতার কারণে ইসলামকে সহীহ ও সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন পন্থা থেকে গবেষণার ভিত্তিতে সঠিক পন্থা নির্ধারণে চার ইমামের গুরুত্ব অপরিসীম। তারা ইসলামের বাণীকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এমন মহান কর্মে নিয়োজিত হন। ইমাম আবু হানিফা বলেছেন আমার যদি কোন ফতোয়া আল্লাহ ও রাসুল এর বিরুদ্ধে যায় তবে তা দেয়ালে ছুড়ে মারো। অন্য ইমামগন একই মত অনুসরণ করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য শুধু ইসলামের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন পথ বলে দেওয়া। তাদেরকে অনুসরণ করানো না। ইসলামকে অনুসরণ করাতে তাদের সৃষ্ট পন্থা নিয়ে আমরা মাথামোটা মানুষ তাদের অনুসরণ করতে শুরু করলাম। এ যেন কলসি রেখে পানি আনতে যাওয়ার মতো।
আমাদের দেশে জাকির নায়েক সম্পর্কে শুরুতে তুমুল বিরোধিতা ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হাতে গোনা কিছু আত্ম অহমিকারী ছাড়া দ্বীনের জন্য তার খেদমতকে স্বীকার করেন। তার ভাষ্য মতে, ইসলামকে অনুসরণ করতে হবে আল্লাহ ও রাসুলের জন্য কোন ইমামের জন্য না। কিন্তু তাদের মতামতকে শ্রদ্ধা করে তিনি সঠিক পন্থা গ্রহণ করতে বলেছেন। সেখানে একজনের অনুসারী বলে তার গবেষণা লব্ধ হাদিস সমূহকে তুলনামুলক কম গ্রহণ যোগ্য হাদিসের বদলে অন্য ইমামের বেশি গ্রহণ যোগ্য মতকে গ্রহণ করার কথা বলেন। কেননা আমাদের উদ্দেশ্য ইসলাম কোন মাজহাব না। জাকির নায়েকে যারা পছন্দ করেন না তারা আসেন আমাদের দেশের ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর,মিজানুর রহমান আজহারী, শায়খ মতিউর রহমান মাদানী কি বলে্ন তা শুনে আসি। আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের মতে, মাজহাব মানতে গিয়ে নিজের ইমামসহ ভিন্নমতকে মেনে নিতে বলেন। শায়খ মতিউর রহমান মাদানী বলেন, চার ইমাম ইসলামের বড় খাদেম কিন্তু তাদের কাছে ওহি আসেনি। তারা ভুলেরে উর্দ্ধে না। ভুল যদি না হবে তাহলে এক ইসলামে চারটি মত। সেখানে একটি সঠিক হলে বাকি তিনটি ইজতেহাদে ভুল বলা যাবে না আবার একশ ভাগ সঠিক বলা যাবে না। তাদের শ্রদ্ধা করেতে হবে, কিন্তু তাদেরকে দাঁড় করে দিয়ে হে ইমাম আপনাকে ছাড়া আর কাহকে মানবো না এটা আপনার গুমরাহি।
আল্লাহ বলেন, “তবে তুমি কি তাকে লক্ষ করেছ যে তার প্রবৃত্তিকে আপন ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? তার কাছে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন (সূরা জাসিয়া-২৩)।” আল্লামা মামুনুল হকের মতে, ইজতেহাদ করে পালন করতে না পারলে প্রতিষ্ঠিত চার মাজহাবের কোন এক জনকে মেনে ইবাদাত করতে হবে। হানাফি মাজহাব ছাড়া অন্য মাজহাব মানা যাবে না এমন নয়, তবে জন সমাজে আমলগুলো যে ভাবে প্রচলিত ভিন্ন কোন ভাবে মানতে গেলে মানুষের মাঝে দ্বিধা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এই জন্য যে সমাজে যে সুন্নার আমল প্রচলিত সেই সমাজে নতুন কোন আমল করার মাধ্যমে মানুষকে পেরেশানিতে না ফেলার পক্ষে মত প্রদান করেন। উল্লেখ্য তিনি সহীহ হাদিস বানার ক্ষেত্রে একাধিক মাজহাব মানাকে ভুল বলেননি। ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, সরাসরি কুরআন
সুন্নাহর উদ্দেশ্য অনেকের জন্য বুঝা সহজ হবে না। এই জন্য প্রয়োজন মাজহাব। আমরা মাজহাবকে দ্বীন মনে করবো না। মুজতাহিদ হিসাবে ওনাদের ভুল থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়।
প্রতিটি মাজহাবে এমন কিছু মতামত রয়েছে যা নিয়ে প্রশ্ন তুলবার সুযোগ রয়েছে। দলিলের ভিত্তিতে কোন আলেম ভিন্ন মত পোশন করলে তাকে বাতিল বা গুমরাহি বলা যাবে না। কেননা আল্লাহ্ বলেন: তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ হতে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না (সূরা : আল আ’রাফ-৩)।
বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিসগন মাযহাব অনুসরণ করতেন। ইমাম বুখারী (র.) নিজেই মুজতাহিদ ছিলেন। তথাপি তিনি শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী বলে সূত্রে পাওয়া যায়। (সুত্রঃ নবাব ছিদ্দিক হাসান খান লিখিত আবজাদুল উলুম পৃষ্ঠা নং ৮১০, আলহিত্তা পৃষ্ঠা নং ২৮৩ শাহ ওয়ালিউল্লাহ র. লিখিত আল-ইনসাফ পৃষ্ঠা নং ৬৭ আল্লামা তাজ উদ্দীন সুবকী রহঃ লিখিত ত্ববকাতুশ শাফেয়ী পৃষ্ঠা নং ২/২)। ইমাম মুসলিম (র.) শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। (সুত্রঃ ছিদ্দিক হাঃ খান লিখিত আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২২৮)। ইমাম তিরমিজী র. নিজে মুজাহিদ ছিলেন। তবে হানাফী ও হাম্বলী মাজহাবের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। (সুত্রঃ শাওয়ালিউল্লাহ রহঃ লিখিত আল-ইনসাফ পৃষ্ঠা নং ৭৯)। ইমাম নাসাঈ (র.) শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। (সুত্রঃ নঃ ছিঃ হাঃ লিখিত আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২৯৩)। ইমাম আবু দাউদ (র.) শাফেয়ী। (সুত্রঃ আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২২৮। ইমাম ইবনে মাজাহ (র.) শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। (সুত্রঃ ফয়জুল বারী ১/৫৮)।
একটি মাযহাবকে আবশ্যক বলা হয় এজন্য যে, একাধিক মাযহাব অনুসরণের অনুমোদন থাকলে সবাই নিজের রিপু পূজারী হয়ে যেত। যখন যে বিধান যখন ইচ্ছে পালন করতো, যে বিধান যখন ইচ্ছে ছেড়ে দিতো। এর মাধ্যমে মূলত দ্বীন পালন হতোনা, বরং নিজের প্রবৃত্তির পূজা হত। তাই ৪র্থ শতাব্দীর উলামায়ে কিরাম একটি মাযহাবের অনুসরণকে বাধ্যতামূলক বলে এই প্রবৃত্তি পুজার পথকে বন্ধ করে দিয়েছেন, যা সেই কালের ওলামায়ে কিরামের সর্বসম্মত সীদ্ধান্ত ছিল। আর একবার উম্মতের মাঝে ইজমা হয়ে গেলে তা পরবর্তীদের মানা আবশ্যক হয়ে যায়।
ইসলাম ধর্মে বিভিন্ন দল আর মত তৈরি করা হারাম। রাসূলবলেন:তোমরা ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা অধিকাংশ ধারণা মিথ্যা হয় (বুখারী -৫১৪৩)। নবীজী ছিলেন মুসলিম এমনকি ইব্রাহিম (আঃ), ইসা (আঃ) মুসলমান ছিলেন। মাজহাব ইসলামের খেদমতের জন্য তবে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো মাজহাব অনুসারে ইসলাম মানবো না কী ইসলাম অনুসারে মাজহাব মানবো। এক্ষেত্রে অনেকেই মাজহাবের অনুসারে ইসলাম মানার কথা দৃঢ় করে প্রচার করেন। যেমন লালন একটা মাজহাব। তার অনুসারীরা মনে করে ৫ বার নমাজে নয় বরং সার্বক্ষণিক স্রষ্টার আরোধনার মধ্যে স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। সুতারং তার অনুসারী তার মতকে মেনে স্রষ্টাকে পেতে চায়। সমস্যাটা এখানে। আল্লাহ্ বলেন:নিশ্চয় সত্যের বিপরীতে ধারণা কোন কার্যকারিতা রাখে না (ইউনূস-৩৬)।
যারা নির্দিষ্ট মাজহাবের পক্ষে তারা কোন দালিলিক প্রমাণ না দিয়ে বলে যান প্রচলিত এই মিথের মতো যে, প্রত্যেক গ্রামে পাড়ায় একটা দিঘি ছিল। অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেখানে সোনার নৌকা ছিল। কোন একদিন কেউ একটা ঝিনুক চুরি করে তখন থেকে আর সোনার নৌকা ওঠে না। এ যেমন কেউ দেখেনি ঠিক তেমনি শুনে শুনে প্রচলন।মাজহাব অনুসারী এমন। কুরআন-হাদীস থাকতে আমরা মাজহাব কেন মানব? এমন অভিনব ধরনের প্রশ্ন ইদানীং অনেকে করে থাকেন। দীর্ঘ ১৪০০ বছর এমন প্রশ্ন কোনো মুসলমান করেননি। কারণ একথা সবাই জানেন যে, শরিয়তের সব বিধানই আল্লাহ ও রাসুল (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত।
কিছু বিধান শরীয়ত অফশনাল রেখেছে, যা ইমামগণ গবেষণার মাধ্যমে বাছাই করে নেবেন। তবু মানুসের মাঝে বিরোধের শেষ নেই। যেমন নামাজের ফরজ মোট ১৪টি। আহকাম ৭ টি। আরকান ৭ টি। নামাজের বাহিরের কাজগুলিকে আহকাম বলে। আর নামাজের ভিতরের কাজগুলোকে আরকান বলে। আহকামঃ ১. শরীর পবিত্র হওয়া। ২. কাপড় বা বস্ত্র পবিত্র হওয়া। ৩. নামাজের জায়গা পবিত্র হওয়া। ৪. সতর ঢেকে রাখা। ৫. কিবলামুখী হওয়া। ৬. ওয়াক্তমত নামাজ আদায় করা। ৭.নামাজের নিয়্যত করা। আরকানঃ ১.তাকবীরে তাহরীমা (আল্লাহু আকবার) বলে নামাজ শুরু করা। ২. দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া। ৩. সুরা ফাতিহার সাথে কুরআন পড়া। ৪. রুকু করা। ৫. দুই সিজদা করা। ৬. শেষ বৈঠক করা। ৭.সালাম ফেরানোর মাধ্যমে সালাত শেষ করা। এসব বিষয়ে কোন বিরোধ নেই। কিন্তু এক শ্রেণির আলেম হাত বাঁধা, জোরে বা আস্তে তাকবীর বলা নিয়ে একজন অন্য জনের মন অনুসরণ করাকে হারাম বলে দেন যা আল্লাহ ও তার রাসূল করেননি।
আল্লামা ইবনে আব্দুল বার (রহঃ) আল- ইন্তেকা নামক কিতাবে হযরত ইমাম মালেক (রহঃ) এর ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ইমাম মালেক (রহঃ) এর ছাত্র মায়ান বিন ঈসা (রহঃ) বলেন- একদা আবুল জুয়াইরিয়া নামক এক ব্যক্তি ইমাম মালেক (রহঃ) এর নিকট মসজিদে নববীতে আগমন করল। এ লোকটি মুরজিয়া হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল। সে এসে ইমাম মালেক (রহঃ) কে বলল-“হে আবু আব্দুল্লাহ! আমার কথা শ্রবণ করুন, আমি আপনার সাথে আলোচনা করব, বিতর্ক করব এবং আমার মতামত উল্লেখ করা মাত্র মালেক (রহঃ) তাকে বললেন-যদি তুমি আমার হে আবু আব্দুল্লাহ! আমার কথা শ্রবণ করুন, আমি আপনার সাথে আলোচনা করব, বিতর্ক করব এবং আমার মতামত উল্লেখ করব। ইমাম মালেক (রহঃ) তাকে বললেন-যদি তুমি আমার উপর বিজয়ী হয়ে যাও? সে বলল-
আপনি আমার অনুসরণ করবেন। ইমাম মালেক (রহঃ) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন-যদি আমি তোমার উপর বিজয়ী হই? সে বলল- আমি আপনার অনুসরণ করব। ইমাম মালেক বললেন- আমাদের নিকট যদি তৃতীয় কোন ব্যক্তি আসে এবং আমরা তার সাথে বিতর্ক করি এবং সে আমাদের উপর বিজয়ী হয়? সে বলল- আমরা তার অনুসরণ করব। ইমাম মালেক তাকে বললেন- আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) কে একই ধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন।
আমি তোমাকে দেখছি-এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছ! হযরত উমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেন- যে ব্যক্তি তার দ্বীনকে বিতর্কের লক্ষ্যবস্তু বানায়, তার ছুটাছুটি বৃদ্ধি পায়” অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি যে, এ সমস্ত অন্ধ অনুসারীগণ তাদের ইমামদের এমনভাবে বিশ্বাস করে যে, তারা এ সব ভুলের ঊর্ধ্বে এবং তারা যা বলে তা অবশ্যই
সঠিক। আর মনের মধ্যে এ বিষয়টি ভাবে যে, প্রকাশ্য দলীলের বিরোধী হলেও সে তাক্বলীদ (দলীল বিহীন অনুসরণ) পরিহার করবে না। দারুল হিজরের ইমাম মালিকের উপর আল্লাহ্ রহম করুন! যার মহৎ জ্ঞান, মহিমা ও অনুগ্রহে “মুওয়াত্ত্বা” সংকলিত হয়েছে।
খলীফা মানসূর যখন সকল মানুষকে শুধু “মুওয়াত্ত্বায় সংকলিত সমস্ত হাদীসের উপর আমল করার জন্য ইচ্ছা পোষণ করলেন, তখন ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) তা গ্রহণ করেন নি। বরং তা প্রত্যাখ্যান করেছেন!! মুকাল্লিদরা দু’টি ক্ষেত্রে প্রতারিত হয়ে থাকেন। তারা মনে করে যে, তাদের এ ধারণা সত্য। অথচ তা সত্য থেকে অনেক দূরে। এ
ধারণা দু’টি আল্লাহর নিন্মোক্ত সাধারণ বাণীর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ বলেন: আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা অনুসরণ কর, যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন, তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে যার উপর পেয়েছি তার অনুসরণ করব (সূরা বাকারা- ১৭০)।
আরব উপদ্বীপের প্রখ্যাত আলেম শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল মুনাজ্জিদ বলেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। এই চারটির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ করা মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,“ তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধরো , পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না (সূরা আল ইমরানঃ
১০৩)। আল্লাহকে ভয় করার কথা বলার পর ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধর’এর আদেশ দিয়ে এ কথা পরিষ্কার করে দিলেন যে, মুক্তিও রয়েছে এই দুই মূল নীতির মধ্যে এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে ও থাকতে পারে এই মূল নীতিরই ভিত্তিতে।
“পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না” এর মাধ্যমে দলে দলে বিভক্ত হওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, উল্লিখিত দু’টি মূল নীতি থেকে যদি তোমরা বিচ্যুত হয়ে পড়, তাহলে তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে তোমরা বিভক্ত হয়ে যাবে। বলাই বাহুল্য যে, বর্তমানে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার দৃশ্য আমাদের সামনেই রয়েছে। কুরআন ও
হাদীস বোঝার এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে পারস্পরিক কিছু মতপার্থক্য থাকলেও তা কিন্তু দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ নয়। এ ধরনের বিরোধ তো সাহাবী ও তাবেঈনদের যুগেও ছিল, কিন্তু তাঁরা ফির্কাবন্দী সৃষ্টি করেননি এবং দলে দলে বিভক্ত হয়েও যাননি। কারণ, তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সকলের আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র ছিল একটাই। আর তা হল, কুরআন এবং হাদীসে রসূল (সাঃ)। কিন্তু যখন ব্যক্তিত্বের নামে চিন্তা ও গবেষণা কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল, তখন আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র পরিবর্তন হয়ে গেল। আপন আপন ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের উক্তি ও মন্তব্যসমূহ প্রথম স্থান দখল করল এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উক্তিসমূহ দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হল। আর এখান থেকেই মুসলিম উম্মাহর মাঝে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হল; যা দিনে দিনে বাড়তেই লাগল এবং বড় শক্তভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেল। সুতরাং দ্বন্দ্ব নিরসনকে কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য কারও দিকে প্রত্যাবর্তন করাকে আল্লাহ্ বৈধ করেন নি। এরা এমন শ্রেণীর লোক যাদের ব্যাপারে ইমাম তিরমিযী ও আদী বিন হাতেম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি (হাতেম) বলেন, আমি নাবী কে পাঠ করতে শুনেছি: তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে (তাওবা-৩১)। ফলে আমি বললাম, হে আল্লাহ্ রাসূল! তারা তো তাদের ইবাদাত করে না।
রাসুল বলেন তারা যখন তাদের জন্য কোন কিছু হালাল করে তখন তারা সেটাকে বৈধ মনে করে। আর তারা যখন তাদের জন্য কোন কিছু হারাম করে তখন তারা সেটাকে হারাম মনে করে। সুতরাং এটাই তাদের ইবাদাত করা হলো। ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত আছে যে, “হাদীস বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোন হালাল কিংবা হারামের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ করবে এবং তাক্বলীদ তাকে সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করতে বাধা দিবে সে যেন আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া তাক্বলীদকৃত ব্যক্তিকে প্রভু হিসেবে মেনে নিল। আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন তা সে তার জন্য হালাল করে নিল। আর আল্লাহ্ যা হালাল করেছেন তা হারাম করে নিল”। মারদাবী শাইখুল ইসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করে বলেন “যে স্বীয় ইমামের প্রতি তাক্বলীদ করাকে আবশ্যক করে নিল, সে যেন এ থেকে তাওবা করে। ” কামাল বিন হুমাম হানাফী বর্ণনা করেন যে, বিশুদ্ধ অভিমত হলো, নির্দিষ্ট কোন মাযহাবকে আবশ্যক করে নেয়া অপরিহার্য নয়। কেননা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যা ওয়াজিব করেছেন তা ছাড়া আর কিছু ওয়াজিব নয়। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কারও প্রতি এটা ওয়াজিব করেননি যে, ইমামদের মধ্যে কোন ব্যক্তির মাযহাবের অনুসরণ করতে হবে এবং দ্বীনের ব্যাপারে তার তাক্বলীদ করতে হবে ও অন্য কিছু বর্জন করতে হবে। অতীতের গৌরবময় শতাব্দীগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সে সময় নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের অনুসরণ করার আবশ্যকতা ছিল না। “সাহাবাদের যুগে একজন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না, যে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির সকল কথার উপর তাক্বলীদ করেছেন এবং তার একটি কথাকেও বাদ দেন নি। আবার এমন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না, যিনি কোন ব্যক্তির সকল কথাকে বাদ দিয়েছেন এবং তার কোন কিছুই গ্রহণ করেননি”।
পরিশেষে আমাদের মতো আমজনতা বিশ্বাস কর বাচতে চায়। যে কোন বিষয়ে এক শতাংশ সত্যি হওয়ার সম্ভবনা থাকলে তাকে ভক্তি করতে চাই। খারিজ করা যুক্তির মাঝে সহনশীলতা দেখতে চাই। যাদের কাছ থেকে দীনের শিক্ষা নেব তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দেখতে চাই। রাসূল (সঃ) এর মতো উদার সহনশীল মনোভাব চাই। নিজেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করার মানসিকতা থেকে অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখতে চাই। আমাদের লক্ষ্য হোক বিভাজিত মনোভাব পরিহার করে এক আল্লাহ ও তার রসূলের উপর সুদৃঢ় থেকে ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত করা। আল্লাহর রাসূলের সুপারিশের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি হোক চুড়ান্ত ফয়সালা।