নিয়াজের দৃঢ় শপথ: “এই জাতি যেন কখনো তাদের আত্মত্যাগ ভুলে না যায়।”
সর্বশেষ আপডেট :
বুধবার, ৯ জুলাই, ২০২৫
৪৪
জন খবরটি পড়েছেন
আলভী আহমেদ, বুটেক্স প্রতিনিধি
জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণ কারী একজন সাহসী যোদ্ধা বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নিয়াজ। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে হওয়া গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতা তাকে শুধু আহত করেনি, বরং দিয়েছে এক গভীর উপলব্ধি ও দৃঢ় সংকল্প—অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনোই মাথা নত করা যাবে না।
নিয়াজের রণক্ষেত্রে প্রথম পদার্পণ ঘটে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই । উত্তাল হয়ে ওঠে মহাখালী-নাবিস্কো মহাসড়ক। কোটা সংস্কার ও চলমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে একসঙ্গে গলা তোলে বুটেক্স, আহসানউল্লাহ ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা।
নিয়াজও ছিলেন সেই জনতার মাঝে। আন্দোলনের মাঝেই খবর আসে—রংপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। বাবার কাঁপা কণ্ঠে ফোনে সেই সংবাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে যান নিয়াজ। সেদিনই উপলব্ধি করেন—এই আন্দোলন আর শুধু কোটার জন্য নয়, এটি এখন এক ভয়ানক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদ।
১৭ জুলাই রাতে হঠাৎ করে ঘোষণা আসে—বুটেক্সের সব হল রাত ১০টার মধ্যে খালি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কেউই প্রস্তুত ছিল না। নিয়াজ ও তার সহপাঠীরা বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেন বনশ্রী-রামপুরা এলাকায়।
১৮ জুলাই সকাল। ক্যাম্পাসে ফেরার পথে নিয়াজ দেখতে পান রামপুরা ব্রিজ পরিণত হয়েছে রণক্ষেত্রে। চারদিকে টিয়ারশেলের ধোঁয়া, কাঁদুনে গ্যাস, রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ হাসপাতালে যাচ্ছে গুরুতর আহত অবস্থায়।
তবুও কেউ পিছু হটছে না। আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ায় সাধারণ মানুষ, আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাও।
১৮ জুলাই সন্ধ্যার পর হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট। এর মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়েসেদিন শুধু ঢাকাতেই শহীদ হয়েছেন ৮০ জনের বেশি। রামপুরা ব্রিজেই প্রাণ হারান ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির দুই ছাত্র।
নিয়াজ স্তব্ধ হয়ে যান। যাদের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা আগেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছেন, আজ তারা শহীদের তালিকায়!
১৯ জুলাই, শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে নিয়াজ বের হন রাস্তায়। চারপাশ থমথমে। রাস্তায় রক্তের দাগ, মানুষের ভিড়, সামনে সিভিল পোশাকে অস্ত্রধারীরা দাঁড়িয়ে।
নিয়াজ চিৎকার করে বলেন, “ভয় পেলে চলবে না! সামনে আসুন!” তারপর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন, “কাল কেন মারলি আমার ভাইদের? কী অপরাধ ছিল তাদের?”
ঠিক তখনই বিকট এক শব্দ। পায়ের নিচে অনুভব করেন উষ্ণ স্রোত। রক্ত!
লোকজন দৌড়ে আসে, গেঞ্জি ছিঁড়ে তার পা বেঁধে দেয় কেউ একজন। দ্রুত এক রিকশায় করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
বনশ্রীর এডভান্স হাসপাতালে ভর্তি হন নিয়াজ। চারপাশে আহতদের আর্তনাদ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। সেই হাসপাতালেই সেদিন শহীদ হন ১১ জন—শিশু, কিশোর, যুবক কেউই রেহাই পাননি।
বিকেলে সেই হাসপাতালেও হামলা চালায় বাহিনী। রোগী, ডাক্তার, নার্স সবাই লুকিয়ে পড়ে দোতলা-তিনতলায়। নিয়াজ নিজেও প্রাণ হাতে করে সেদিন বেঁচে ফেরেন।
৫ আগস্ট, আহত শরীরে নিয়াজ বের হন শহরের দিকে। দেখেন এক নতুন ঢাকা—মানুষ মুক্তির আনন্দে মুখরিত। এই পরিবর্তনের পেছনে শহীদদের রক্ত আছে, আছেন আহত যোদ্ধারা।
নিয়াজের দৃঢ় শপথ—”এই জাতি যেন কখনো তাদের আত্মত্যাগ ভুলে না যায়।”
আন্দোলনের দিনগুলো নিয়াজের হৃদয়ে চিরস্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছে। নিয়াজ বুঝেছেন—এই শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখা প্রয়োজন ইতিহাসের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য। তাই তিনি গড়ে তুলেছেন একটি ওয়েবসাইট, যেখানে সংরক্ষিত হচ্ছে শহীদ, আহত ও নিখোঁজদের তথ্য।
“প্রথমে ওয়েবসাইট বানানোর পরিকল্পনা ছিল না,” বলেন নিয়াজ, “কিন্তু ভয় ছিল, শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে। তাই এই ইতিহাস রক্ষা করা দরকার।”
বন্ধু শাহরিয়ার-এর সঙ্গে মিলে মাত্র দুই সপ্তাহে www.genocide2024.info ওয়েবসাইটটি তৈরি করেন তিনি। এরপর বিভিন্ন পত্রিকা, সরকারি ও বেসরকারি সূত্র থেকে যাচাই-বাছাই করে ১৫০ জনের বেশি শহিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তাদের শাহাদাতের বিবরণ যুক্ত করেন।
তাদের লক্ষ্য শুধু তালিকা নয়—শহীদ, আহত ও নিখোঁজ সকলের পরিচয়, জীবনগল্প এবং অবদান তুলে ধরা। ভবিষ্যতে এটি নিয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ করার ইচ্ছাও রয়েছে, পাশাপাশি সরকার থেকে স্বীকৃতির কাজ চলছে।
নিয়াজ বলেন, যদি কেউ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চান, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এই আন্দোলন শুধু অতীত নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য। ইতিহাস যাতে ভুলে না যাই—সে দায়িত্ব আমাদের সবার।