মোঃ মাসুম বিল্লাহ।। বহমান সময়ের পথে হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে যখন বর্তমানের অন্তরালে অতীতের ছবি ভাসে, তখনি শিহরিত হয় মন। আদিম সমাজের বর্বরতা তুচ্ছ হয় সভ্য সমাজের অসভ্যতার কাছে। সুধীজনের মুখে
সমাজ ব্যবস্থার জাঁতা কলে পিষ্ঠ হৈমন্তীকে দেখে অনেকের হয়তো বেদনায় বিগলিত হয় মন। এক সময় আমারও ঘৃণা ছিল। তবে তীব্র ঘৃণা করার আর্তনাদ হারিয়ে ফেলেছে মন। আজ থেকে কয়েক যুগ পূর্বের হৈমন্তী আর বর্তমান সময়ের হৈমন্তীদের দেখ ঘৃণাটা প্রশমিত হয়; না উদ্যোমিত হয় তার বিচার নিজেরাই করবেন। আমাদের সামাজে
সাহিত্যের উৎকর্ষতা সাধিত হলেও নকশা ধর্মী লেখা আমাকে আকর্ষণ করে। সবাই যদি সাহিত্যের রস সৃষ্টির জন্য সাহিত্য লেখে তবে সামাজিক অন্তঃসারতা কীভাবে দূরীভূত হবে।
কথা হচ্ছিল হৈমন্তী প্রসঙ্গে। হৈমন্তী পড়ে যদি কেহ হিন্দুয়ানী সমাজের চিত্র খুঁজে রবীন্দ্রনাথকে নিছক হিন্দু লেখক মনে করেন; তবে আমি বলব তার বই পড়ার দরকার নেই। আমাদের সমাজে অবশ্য স্বেচ্ছায় বই পড়া লেখক হাতে গোনা কয়েকজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এখন পরীক্ষার পূর্বে কিছু ঐতিহ্যগত নোট পড়ে কোনো রকম একটা ফলাফল নিয়ে বের হতে পারলে হাফ ছেড়ে বাঁচে। আর বাঁচবে না কেন চাকুরী এখন আর শুধু সার্টিফিকেটের গুণে হয় না; তার জন্য আরো বহুবিধ গুণের দরকার। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এখন পরিণত হয়েছে সার্টিফিকেটের আড়তে। আর শিক্ষকেরা আড়তদার। রবি ঠাকুর হৈমন্তীর অন্তরালে তৎকালীন সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রধানতম বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করানোর চেষ্টা করেছেন। সেখানে হিন্দু বা মুসলমান বলে কিছু নেই। সাহিত্য না জীবন আগে? সবাই এক বাক্যে বলবে জীবন। আর যদি জীবন আগে হয়, তবে বলব জীবনের শ্রী বৃদ্ধি করে সাহিত্য। মানুষের
২। জীবনের সকল ঘটনা কোন না কোন পর্যায়ে সাহিত্যের মধ্যে অর্ন্তভূক্ত হতে পারে। জীবনের গল্প নিয়ে যদি সাহিত্য রচিত হয় তবে, জীবন কেন্দ্রিক সকল ঘটনা সাহিত্যের অর্ন্তভূক্ত। সাহিত্য আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং যে জীবনকে নিয়ে সাহিত্য তার কথায় আসা যাক, আসা যাক হৈমন্তী ও বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়। অনেক দিন পূর্বে হৈমন্তী যা করতে চেয়েছিল; বর্তমানে তা কোথায়? হৈমন্তী গল্পে নির্দিষ্ট কিছু সমস্যার প্রতি চোখ আটকে যায়। লেখকের লেখার উদ্দেশ্য কিছু জানি না। তবে মনে হয় হয়তো তিনি এর মাধ্যমে সমস্যার এক দিন সমাধান হবে বলে মনে করেছিলেন। হৈমন্তী স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এক নারী। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার জাঁতা কলে পিষ্ঠ হয়ে সে শিক্ষা কোন আলো জ্বালাতে পারেনি। মেয়ে বড় হলে তাকে ঘরে রাখা রীতি মতো ধর্ম বিরুদ্ধ শুধু নয়, সমাজ বিরুদ্ধ কাজ। তাছাড়া বয়স কম মেয়েকে বিয়ে করা তৎকালীন সমাজের ন্যায় আজও গর্বের বিষয় মনে করা হয়। পণ প্রথার
নির্মমতায় হৈমন্তী দিনে দিনে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। স্বামী ব্যক্তির অত্যাধিক পিতৃ ভক্তি স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য পালনে কেবল উদাসীন করে না, দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। একের কারণে অন্যের উপর কসুর করা সমাজের চিরায়ত নিয়ম। তাই হৈমন্তীর অপরাধে পিতা পর্যন্ত বাদ পড়েনা কথা শুনতে। আবার যৌতুকের টাকা বেশি হলে অচল সচল হয়ে যায়। বর্তমান হৈমন্তীদের দেখে আরো বেশি হতাশ হই।
আমাদের সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক সম্যসা ইভ টিজিং। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলের দ্বারা স্কুলগামী ছাত্রীকে ইভ টিজিং এর স্বীকার হতে দেখা যায়; হৈমন্তী তদরূপ ছিল না। ভোগ মানুষে স্বহজাত আদিম প্রকৃতি। ভোগের জন্য সমাজ স্বীকৃত প্রথা আছে, নির্দষ্ট সময় আছে। কিন্তু এখন মানুষ ভোগের জন্য ভুগছে। আর এ ভোগের জন্য যে
কোন গর্হিত কাজ করতে তারা পিছুপা হয় না। অপুকে দেখে মনে হয় ভোগ বৃত্তির জন্য হৈমন্তীকে বিয়ে করেছিল। তাই স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে সে উদাসীন ছিল। এটা তো গেল জৈবিক চাহিদা আর পেটের চাহিদার জন্য নেওয়া হয় যৌতুক। এখনকার সময় জৈবিক চাহিদার জন্য বিয়ে না বরং ততোদিন অপেক্ষা অসাধ্য। তাইতো এখানে সেখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। চার থেকে পঞ্চাশোর্দ্ধ নারী আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত হচ্ছে। চার বছরের শিশু যখন ধর্ষিত হয় তখন কোথায় যেন হারিয়ে যায় হৈমন্তীর কষ্ট। চৌদ্দ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে যখন তা
ক্যামেরা বন্দী করে সিডি আকারে বাজারজাত করা হয় তখন কোথায় যায় শিক্ষা। ভালোবাসার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারণে কুপিয়ে যখম হতে হচ্ছে কলেজ ছাত্রীকে।
৩। হৈমন্তীর সমাজে হয়তো এমনটা কল্পনাও করা যেতো না। পণের টাকা না পেয়ে অপুর দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা শুনা যায়। কিন্তু এখন যৌতুকের দাবী না মিটালে গায়ে এসিড মেরে ঝলসে দেওয়া হয়, কেরসিন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় নারীর শরীর। দ্বিতীয় বিয়ে তো কথার কথা এক সাথে চার-পাঁচটি বউ দেখা যায়। আর যৌতুক না পেলে
হৈমন্তীর মতো শুধু শ্বশুর বাড়ির ঝগড়া শুনতে হয় না; বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্বামী শ্বশুরের হাতে অত্যাচারিত হয় নারী। বেলেট দিয়ে যখম করে লবণে প্রলেপ দেওয়ার ঘটনাও চোখে পড়ে। এ নির্মমতা সভ্য সমাজে
হৈমন্তীকে হার মানায়। না বলা যন্ত্রণা বয়ে বয়ে নারী জীবনে জন্ম দিচ্ছে হতাশা। আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হৈমন্তী এখন শারীরিক নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত। যৌতুকের দাবী মিটাতে হতে হয়েছে অনেক পিতাকে র্স্বশান্ত। বয়স বেড়ে যাওয়ায় মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে পিতা-মাতার উদ্বিগ্নতার শেষ
নেই। সমাজ ব্যবস্থার কানাকানি কলরব পিতা-মাতার বুকে বিধে। উচ্চ শিক্ষার দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে এখনো নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে করতে ব্যস্ত। নারী সামাজিক মর্যদা এখন পর্যন্ত স্বীকৃত নয়। যৌবনের তাগিদে পুরুষ একাধিক বিয়ে করতে পারে। নারী বিধবা হলে নিরাপত্তার তাগিদে বিয়ে করলে সমাজের কুদৃষ্টি পড়ে। আশেপাশে চোখ মেলে তাকালে দেখা যায় যে, পঞ্চাশোর্দ্ধ পুরুষ জীবন সঙ্গিনী হারিয়ে অতি দ্রুত বিয়ে করে। তখন বেচারাকে বড় অসহায় মনে করে সকলে।
একই ঘটনা কোন ত্রিশ বছর নারীর ক্ষেত্রে হলে সমাজের ধিক্কার রব ওঠে। কি দরকার ছিল? ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি দিন পার করলে কী হত! পত্রিকার পাতায় নিম্নোক্ত খবরটি দেখে নিরব কান্না নামে চোখে।
কোন এক মহিলা পেশা শিক্ষকতা। স্বামী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। হঠাৎ স্বামীর মৃত্যু। অক্লান্ত কষ্ট করে মহিলা ছেলেটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। ইতোমধ্যে মহিলার উপর সামাজিক, মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি নারীত্ব হরণের কিছু লোকের লোভাতুর দৃষ্টি পড়ে। অনিশ্চিত জীবনের অনিশ্চয়তা, মানসিক যন্ত্রণার মুক্তি, একটু আশ্রায়, শান্তির সাথে নিঃশ্বাস নেওয়া এবং নিজের কষ্টের একজন ভাগীদার পাওয়ার জন্য বিয়ে করেন; আর তখন ছেলেটি মায়ের সাছে সকল যোগাযোগ ছিন্ন করে। মা বেচারীর আর্তনাদ “যে ছেলের জন্য এত কিছু করলাম, আমার নাড়ী ছেঁড়া ধন যার সাথে একদিন কথা না বলে থাকতে পারি না। আজ সে ছেলে আমার সাথে কথা বলে না, বাড়ি আসে না। একটু নিরাপত্তার জন্য আমার বুকের মানিক আমাকে ভুলে গেছে।” এই যদি হয় বাস্তবতা তবে পিতার ক্ষেত্রে কেনো হয় না?
৪। আজ আমাদের সমাজের অজ হৈমন্তী রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীকে হার মানায়। হৈমন্তী আজ আত্ম-সম্মানের ভয়ে নিরব, না বলতে পারার কষ্ট বয়ে ক্লান্ত। সমাজের নিম্ন স্তরের লোক বলে প্রশাসনিক সহযোগিতা মান- সম্মানের হানি ছাড়া স্বস্তি দেয় না। হৈমন্তী করুণ আর্তনাদ আর কত দিন চলবে?এর নাম কী আধুনিকতা? আর কবে নারী জীবনের দুর্দশা লাঘবে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো বন্ধ হবে। সবুজ প্রকৃতির বুকে হৈমন্তী বেড়ে উঠবে তার স্বাধীন মনোবৃত্তি নিয়ে। পুরুষের সঙ্গী হয়ে স্বপ্ন লোকে ভাসবে। তবেই হৈমন্তী কিছু দিতে পারবে জাতিকে, দেশকে।
লেখক -প্রভাষক ,ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, জাহানাবাদ সেনানিবাস, খুলনা