বিলাল হোসেন মাহিনী ।। দুই বিজয়ের স্বাদ লভিছে বাংলাদেশ। বাংলার তরুণ প্রজন্ম। ১৯৭১; ডিসেম্বর মাস। বীর বাঙালি, সিপাহি-জনতার বিজয়ের মাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লাখ শহিদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার গ্রাফিতি বিজয়ের মাস নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয় এ মাসে। কিন্তু অতীব দুঃখের কথা হলো, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমরা গনতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা পাইনি। দেশের মানুষ বেশিরভাগ সময় ছিল স্বৈর ও ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে জিম্মি। বৈশ্বিক উন্নয়নের সাথে খাপখাইয়ে দেশে ডিজিটালাইজেশ ও উন্নয়নে কিছুটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হলেও পূর্ণ গনতন্ত্রের বিকাশ, সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্থায়ী হলে বাংলাদেশ সত্যিকারের কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
আমরা তথা তরুণ প্রজন্ম বিশ্বাস করি, অন্তর্বতিকালীন সরকার সেই প্রত্যাশা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ইতোমধ্যে প্রায় ডজন খানেক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অতীব দুঃখের কথা হলো, জাতি যা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, সেই শিক্ষা সংস্কার কমিশন এখনো হয়নি। বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা, অর্জন করে নিজস্ব ভূ-খন্ড। আমরা পাই সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিলো, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এ দিনে। স্বাধীনতরা ৫৩ বছর পর বাঙালির আত্মপরিচয়ের তথা নাগরিক হিসেবে স্বকীয়তা রক্ষায় আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা তথা ৩৬ জুলাই নতুন প্রেরণা হবে। রাজনীতিতে নতুন বন্দোবস্ত হবে। দেশের মানুষ ফিরে পাবে প্রকৃত স্বাধীনতা। লাল সবুজের পতাকা, একটি স্বধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র যাদের নেতৃত্ব ও অবদানে আমরা পেয়েছি তাদের মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ স্বাধীনতার ময়দানের সকল বীর সেনানীর অবদান সর্বাগ্রে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে, প্রতিটি ঘটনার সাথে যাদের ত্যাগ জড়িত, প্রত্যেকের সমান সম্মান প্রদান করা হোক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন; ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সাধারণ নির্বাচন; ১৯৬২ সালে শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন; ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন; ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা; ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথান; ১৯৭০ সালের নির্বাচন; ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ; ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা; ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। সংগ্রামের মহানায়ক মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব, শহীদ জিয়া, জাতীয় চার নেতা, আ স ম রব, শাহজাহান সিরাজ, ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ অসংখ্য বীর যোদ্ধার অসামান্য অবদান রয়েছে। দুর্নীতি আর পুকুর চুরি না হলে আমরা উন্নত রাষ্ট্রে অবস্থান করতাম।
৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যূাত্থানের পর বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সম্মানজনক দেশ ও রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আমাদের আরও অনেক বিষয়ে আরও গভীর মনোযোগ দিতে হবে। যেমন, সুশাসন ও গণতন্ত্র। এজন্য রাজনৈতিক সহাবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। ৫০ বছরে আমাদের যে উন্নয়ন, তার মধ্যে ‘সুশাসন’-এর অভাব প্রকট। উচ্চ প্রবৃদ্ধি সুশাসনের বিকল্প নয়। প্রবৃদ্ধি ও সুশাসন পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। এ যোগসূত্র দুটোকেই বেগবান ও টেকসই করবে, ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে এখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। নতুন বাংলাদেশে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন ও গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রা শুরু হোক, হোক রাজনীতিতে নতুন বন্দোবস্ত। এটিই হোক সবার আন্তরিক অভিপ্রায়। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুশাসন হোক রাষ্ট্রের চলার পাথেয়।
বিলাল মাহিনী নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।